
শুল্ক কূটনীতি: বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও ভারতের চ্যালেঞ্জ
শুল্ক আরোপ শুধু অর্থনৈতিক অস্ত্র নয়, এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী হাতিয়ার। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থ নয়, ভিন্নমত দমনের প্রচেষ্টাও রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, জ্বালানি নিরাপত্তা, অস্ত্র ক্রয় এবং ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর শুল্কনীতি। অথচ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ওপর শুল্কের চাপ শুরুর তুলনায় কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা দুই প্রতিবেশী দেশের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন বার্তা বহন করে।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, ভারত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে লাভবান হচ্ছে, কিন্তু মার্কিন পণ্যের জন্য সমান সুযোগ দিচ্ছে না। এর ওপর ভারত যখন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র ক্রয় করে, তখন ট্রাম্পের ভাষায়, ‘ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়’।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এক প্রকার ‘অর্থনৈতিক শাস্তি’। ট্রাম্পের অভিযোগ, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনে খোলা বাজারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করছে এবং পরোক্ষভাবে ইউক্রেইন যুদ্ধকে সমর্থন করছে। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে, তবু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
ঠিক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর তুলনামূলক বিচারে কম শুল্ক আরোপ করেছে, এটিকে নিছক কাকতাল ভাবলে ভুল হবে। বরং এটি মার্কিন বাণিজ্য ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি কৌশলগত পুনর্গঠন। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায় ভারসাম্য আনতে চায়, যেখানে ভারতকে চাপে রেখে বাংলাদেশ বা অন্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্পে আমাদের মজবুত অবস্থান, প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি, এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি, জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে আগ্রহী করছে। এই শুল্ক ছাড় বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানি সম্প্রসারণের নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আবার ‘ডিপ স্টেট’ সংক্রান্ত গল্পও একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের রাশিয়া সফরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ট্রাম্প যখন ভারতকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, তখন দোভাল রাশিয়ার সঙ্গে খনিজ তেল আমদানির বড় চুক্তিতে প্রবেশ করছেন। এটি কেবল বাণিজ্য নয়, কৌশলগত অবস্থান। ভারত মনে করে, বহুমুখী সম্পর্ক বজায় রাখা জাতীয় স্বার্থের জন্য উপযুক্ত, এবং এই চুক্তিগুলি ওই কৌশলের অংশ। যদিও ট্রাম্প এটিকে ‘রুশপন্থী’ আচরণ হিসেবে দেখছেন, তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বৈত সম্পর্ক বিরল নয়।
এছাড়া, ভারতের যুক্তি হলো, যখন ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস ও ইউরেনিয়াম আমদানি করে, তখন শুধু ভারতকে টার্গেট করা অন্যায়। এমনকি ২০২৪ সালে ইউরোপ রাশিয়ার সঙ্গে ৬৭.৫ বিলিয়ন ইউরোর বাণিজ্য করেছে। এর তুলনায় ভারতের রুশ বাণিজ্যের পরিমাণ নগণ্য।
এই নতুন শুল্ক কূটনীতির আগুনে শুধু ভারত নয়, জ্বলছে ব্রাজিলও। ব্রিকসভুক্ত আরেক ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ব্রাজিলের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা প্রতিবাদে বলেছেন, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ করতে চান না, বরং মোদী ও শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। এই বক্তব্যে তিনি ট্রাম্পের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এবং ব্রিকস গোষ্ঠীর ভিত শক্তিশালী করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ব্রিকসের সম্প্রসারণ, যৌথ মুদ্রা চালুর চিন্তা এবং ট্রাম্পের একক আধিপত্যবাদী নীতির বিরোধিতা ইঙ্গিত দেয় যে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম হতে যাচ্ছে, যেখানে মার্কিন শুল্কনীতি বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।
ডনাল্ড ট্রাম্প একজন ‘চুক্তি-নির্ভর’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে লেনদেনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। মার্কিন পণ্য যদি কোনো দেশে বিক্রি না হয়, তবে সেই দেশ তার কাছে ‘ভালো অংশীদার’ নয়। আর যদি সেই দেশ চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়, তবে তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত।
তবে প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ যদি বাণিজ্য প্রসার হয়, তাহলে ভারতের মতো বড় বাজারকে শাস্তি দিয়ে লাভ বা ক্ষতি কার বেশি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বোঝা যায়, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেওয়া হয়, দীর্ঘমেয়াদি কূটনীতির স্বার্থে নয়।
এই নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি সোনালী সুযোগ। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ছাড় শুধু একক সুবিধা নয়, বরং একটি কৌশলগত অবস্থানের প্রতিফলন। আমাদের কূটনীতিকদের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চুক্তির ভিত্তি তৈরি করা উচিত। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিকসভুক্ত দেশ এবং রাশিয়ার সঙ্গেও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। বাংলাদেশ যদি এই কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, তাহলে আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি সহযোগিতায় অভাবনীয় অগ্রগতি সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এখন আর কেবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নয়, বরং বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায়। ভারতের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, ব্রাজিলের প্রতি অবজ্ঞা এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুকূলতা—এই তিনটির মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট বার্তা পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বকে নতুনভাবে সাজাতে চায়, যেখানে বন্ধুত্ব মানে ‘আমার নিয়ম মানো’। এই বিশ্বরাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের জন্য সুযোগ আছে, আবার আছে ঝুঁকিও। আমরা যদি দৃঢ় কূটনৈতিক দক্ষতা ও বহুমুখী বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করি, তাহলে এই দুর্যোগকে সুযোগে রূপান্তর করা সম্ভব। ভারত যেখানে তার কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবছে, সেখানে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে নির্ভরযোগ্যতা, স্থিতিশীলতা এবং কৌশলগত দূরদর্শিতা নিয়ে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কূটনৈতিক তৎপরতা
- শুল্ক আরোপ