
আমেরিকাকে মহান করতে দিদারুলের মৃত্যু
নিউইয়র্ক পুলিশের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলাম (৩৬) নিজের জীবন দিয়ে অভিবাসী কমিউনিটির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদ্বেষমূলক কটূক্তি ও মিথ্যাচারের কড়া জবাব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা রক্ষা করতে গিয়ে সন্ত্রাসীর প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে সাহসী বাংলাদেশি দিদারুলের আত্মদানের দৃষ্টান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি অভিবাসী নয়, সব অভিবাসী কমিউনিটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। তিনি বীরের মতো জীবন দিয়েছেন। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ, ফায়ার ডিপার্টমেন্টসহ সিটির অন্যান্য ইউনিফর্মধারী সংস্থার সদস্যরা তাকে নজিরবিহীন আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা ও বীরোচিত বিদায় জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী কমিউনিটির গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও প্রকাশ্যে কেবল ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের টার্গেট করে তাদের ব্যাপক ধরপাকড় ও বিতাড়ন শুরু করেছেন, কিন্তু বাস্তবে তার টার্গেট বৈধ-অবৈধ সব অভিবাসী। কারণ বিগত দিনগুলোতে তার অভিবাসী বিতাড়ন অভিযানে গ্রিনকার্ডধারী, এমনকি অনেক ন্যাচারালাইজ্ড আমেরিকান সিটিজেন আটক হয়েছেন এবং তাদেরও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অভিবাসী কমিউনিটিতে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুবার উচ্চারণ করেছেন, তারা আমাদের জাতির রক্ত কলুষিত করছে; তারা সমগ্র পৃথিবী থেকে কারাগার ও পাগলা গারদ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসছে। তার কণ্ঠে জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলারের প্রতিধ্বনি। হিটলার যেমন তার গ্রন্থ ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এ অভিবাসী ও জাতিবর্ণের মিশ্রণের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘অতীতের সব মহান সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেছে, মূলত সৃজনশীল জাতি শুধু ‘রক্ত কলুষিত’ হওয়ার কারণে।” প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাৎসি হিটলারের চেয়ে আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বলছেন, “অভিবাসীরা ভয়ংকর অপরাধী, ওরা অবৈধভাবে ভোট প্রদান করছে, আমাদের পালিত পশুপাখি খেয়ে ফেলছে, আমাদের জরুরি তহবিলের অর্থ শোষণ করছে এবং আমাদের চাকরি চুরি করছে। তাছাড়া আমরা এখন আমাদের দেশে প্রচুর বাজে ‘জিন’ (বংশধারা) পাচ্ছি।” এর চেয়ে জাতিবিদ্বেষমূলক বক্তব্য আর কী হতে পারে!
গত ২৮ জুলাই নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনের এক বহুতল ভবনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে বহু নিরীহ মানুষের জীবন রক্ষা করার লড়াইয়ে জীবন দিয়ে বাংলাদেশি আমেরিকান প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে জননিরাপত্তা রক্ষায় কতটা আত্মনিবেদিত হতে পারে এবং বিদ্বেষ উসকে দেওয়া আমেরিকার শীর্ষ রক্ষণশীল ও কট্টর নেতা ট্রাম্পের বক্তব্য কতটা ভ্রান্ত, ফাঁকা বুলি ও অন্তঃসারশূন্য। সন্দেহ নেই, অভিবাসীরা উন্নত জীবনের জন্য ‘আমেরিকান ড্রিম’ বাস্তবায়নে আসে; কিন্তু বাস্তবে তাদের অধিকাংশই নিজ নিজ মেধা, যোগ্যতা ও শ্রমে আমেরিকাকে আরও বিকশিত করার ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রাখে এবং আমেরিকাকে নিজের দেশ হিসাবেই বরণ করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই বসবাস করেন দেশটির সবচেয়ে জনবহুল সিটি নিউইয়র্কে। এ সিটির প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিভাগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের বিচরণ প্রায় অবাধ হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শাহানা হানিফ। তিনি সিটি কাউন্সিলে প্রথম নির্বাচিত বাংলাদেশি কাউন্সিলরম্যান। তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আরও বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছে এবং নির্বাচনি দৌড়ে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। গত জুনে সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানির বিজয় লাভে বাংলাদেশি ভোটাররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি) যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো বড় সিটির, এমনকি অনেক অঙ্গরাজ্যের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বৃহত্তম। বর্তমানে এনওয়াইপিডির সক্রিয় জনশক্তি ৩৫ হাজারের বেশি। বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সহ-প্রতিষ্ঠাতা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শামসুল হক, যিনি ২১ বছর পুলিশে চাকরি করার পর সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন, তার মতে, বর্তমানে নিউইয়র্ক পুলিশে ৯০০ থেকে ১০০০ পুলিশ অফিসার কর্মরত রয়েছেন। তাদের মধ্যে চারশর অধিক ‘বাপা’র সদস্য। এছাড়া এনওয়াইপিডির সহযোগী সংস্থা ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট অফিসার ও স্কুল সেফটি অফিসারসহ আরও দেড় সহস াধিক ইউনিফর্মধারী বাংলাদেশি নারী-পুরুষ আমেরিকান পুলিশে কর্মরত রয়েছেন। নিউইয়র্ক সিটি প্রশাসনের অধীনে যেসব সংস্থা ও বিভাগ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পুলিশ বিভাগ অন্যতম এবং সব ঝুঁকি সত্ত্বেও পুলিশের চাকরি আকর্ষণীয়। যেসব বাংলাদেশি আমেরিকান ইতোমধ্যে পুলিশ বিভাগে কর্মরত, তাদের অনুসরণ করে শিক্ষিত বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা ক্রমেই পুলিশে যোগদানে আগ্রহী হয়ে উঠছে। পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামের স্থাপন করা দৃষ্টান্তে তারা আরও বেশি সংখ্যায় এনওয়াইপিডির পুলিশ অফিসার হিসাবে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হবে বলে আশা করেন সাবেক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শামসুল হক।