
বিমান দুর্ঘটনায় ট্রমাগ্রস্ত শিশুদের পাশে দাঁড়াতে হবে
ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর আমাদের হৃদয় যখন শোকে ভারাক্রান্ত, তখন একটি বিষয় আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। এটি দৃশ্যমান নয়, কিন্তু এর অভিঘাত গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি। ছোট ছোট শিশুরা, আমাদের নিষ্পাপ সন্তানরা, এমন এক বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে, যা কোনো শিশুর দেখা উচিত নয়। জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ, পোড়া মরদেহ, রক্তাক্ত সহপাঠীদের আর্তনাদ এবং পরিচিত স্কুল প্রাঙ্গণে মৃত্যুর ভয়াল থাবা।
এ অভিজ্ঞতা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, বরং তাদের কোমল মনের ওপর এক গভীর ক্ষত। এ ধরনের দৃশ্য শিশুদের মনে যে ভয় ও আতঙ্কের জন্ম দেয়, তা সহজে মুছে যায় না। যদি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের মানসিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে এ ট্রমা ধীরে ধীরে গভীর মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে। অবসাদ, আতঙ্ক, অস্বাভাবিক আচরণ, দুঃস্বপ্ন, এমনকি আত্মবিকাশেও চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কাল যারা ছিল প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি, আজ তারা হয়ে উঠতে পারে নিঃসঙ্গ, ভীত কিংবা হতাশাগ্রস্ত, যদি আমরা তাদের এ গভীর যন্ত্রণাকে অবহেলা করি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু মানে শুধু আকারে ছোট মানুষ নয়। তাদের মানসিক গঠন ভিন্ন, তাদের অনুভূতি অতি সংবেদনশীল। তারা ভয়াবহতা দেখলে তা গভীরভাবে তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু বা আহত অবস্থা প্রত্যক্ষ করা, নিজেকে অসহায় মনে করা-এসব বিষয় শিশুর মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে।
এটি একটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা। সরকার, স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিশু মনোবিজ্ঞানী এবং ট্রমা কাউন্সেলর নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি শিশুর মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করে প্রয়োজন অনুযায়ী থেরাপি দিতে হবে। গ্রুপ কাউন্সেলিং, আর্ট থেরাপি, প্লে থেরাপি ইত্যাদি বিলাসিতা নয়, বরং একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন তারা শিশুর ট্রমার লক্ষণগুলো বুঝতে পারেন এবং ঘরে ও ক্লাসরুমে একটি সহানুভূতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। এর বদলে নীরবতা কিংবা অবহেলা হবে চরম নিষ্ঠুরতা। দুর্ঘটনার পর যদি আমরা আরেকবার তাদের অবহেলা করি, তাহলে সেটি হবে জেনেশুনে আরেকটি অপরাধ।
আমরা যেন মনে রাখি, ভবন পুনর্র্নির্মাণ করা যায়, রাস্তা মেরামত করা সম্ভব হয়, কিন্তু একটি ভেঙে যাওয়া মন যদি সময়মতো সেবা না পায়, তাহলে তা কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে না। আমাদের শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কেবল সমবেদনা প্রকাশ নয় তাদের আরোগ্য, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের আশ্বাস দেওয়া। আমরা যেন উদাসীন না হই, এখনই পদক্ষেপ নিই, যাতে এ বিভীষিকা তাদের জীবনের চিরন্তন ছায়া না হয়ে দাঁড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আজকের বিশ্বের অন্যতম জরুরি এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি বিষয় হিসাবে স্বীকৃত। এটি যে কারও জীবনে-যে বয়স, পেশা বা পরিবেশেই হোক না কেন-প্রভাব ফেলতে পারে। শারীরিক রোগ দেখা যায়, কিন্তু মানসিক আঘাত অনেক সময় অদৃশ্য থাকে, এর প্রভাব হয় দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী। সময়মতো যত্ন না নেওয়া হলে এ মানসিক চাপ ধীরে ধীরে গুরুতর মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে, যা ব্যক্তির জীবনমান, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, কাজের দক্ষতা এবং সামগ্রিক সুস্থতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। দুর্ঘটনা, প্রিয়জন হারানো, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, যুদ্ধ বা সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চাকরি হারানো বা বৈবাহিক বিচ্ছেদ। এসব ঘটনার কারণে মানসিক আঘাত তৈরি হতে পারে। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য স্কুলের চাপ, পারিবারিক কলহ, অবহেলা, বা সহপাঠীদের দ্বারা বুলিং মানসিক যন্ত্রণার উৎস হতে পারে। কখনো কখনো ছোট ছোট ঘটনা, যদি তা বারবার ঘটে বা আবেগপ্রবণ সময়ে ঘটে, তবুও তা দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা সৃষ্টি করতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মানসিক স্বাস্থ্য
- বিমান বিধ্বস্ত