
টেকসই কৃষির জন্য চাই কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন
বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এই কৃষি খাত শুধু খাদ্যনিরাপত্তাই নিশ্চিত করে আসছে না, বরং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তবে আধুনিক বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী কৃষির উন্নয়ন শুধু উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; বরং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজারজাতকরণের প্রতি সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের ভ্যালু এডিশন বা মূল্য সংযোজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কাঁচা পণ্য, যেমন ধান, টমেটো, দুধ ইত্যাদি কম দামে বিক্রি হয়। কিন্তু এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে সস, দই বা পনিরে রূপান্তর করলে তার মূল্য বহুগুণ বেড়ে যায়। এতে কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান।
ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের চাহিদা থাকলে দেশজুড়ে ছোট-বড় প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠে, যেমন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, ফল সংরক্ষণ কারখানা। এতে কর্মসংস্থান তৈরি হয় ও গ্রামীণ শিল্পায়ন ঘটে। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য কাঁচা অবস্থায় রপ্তানি করলে কম দামে বিক্রি হয়। কিন্তু শুকনো আম, জ্যাম, প্যাকেটজাত মসলা ইত্যাদি রপ্তানি করলে আন্তর্জাতিক বাজারে অধিক মূল্য পাওয়া যায়। অনেক কৃষিপণ্য, যেমন আম, টমেটো, দুধ ইত্যাদি দ্রুত নষ্ট হয়। ভ্যালু অ্যাড করলে যেমন আম দিয়ে আমসত্ত্ব, দুধ দিয়ে ঘি—পণ্য সংরক্ষণ করা যায় এবং অপচয় কমে। ঘরে বসেই অনেক নারী কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে আয় করতে পারেন। যেমন আচার তৈরি, শুকনো খাবার বা ঘি উৎপাদন। এটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করে।
ভ্যালু অ্যাডের মাধ্যমে কৃষক বা উদ্যোক্তা নতুন ধরনের পণ্য বাজারে আনতে পারেন, যেমন বেবি ফুড, হেলদি স্ন্যাকস, হোল গ্রেইন সিরিয়াল ইত্যাদি। এতে ভোক্তার চাহিদা পূরণ হয় এবং বাজার প্রতিযোগিতা বাড়ে। এক কেজি কাঁচা আম বিক্রি হয় হয়তো ৪০ টাকা। কিন্তু এই আম দিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে প্যাকেটজাত করলে তা বিক্রি হতে পারে ২০০-২৫০ টাকায়। এভাবেই ভ্যালু অ্যাড কৃষিপণ্যের মূল্য বাড়ায়। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষকের উন্নয়ন এবং রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কৃষিপণ্যের ভ্যালু অ্যাড অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ ও নীতিগত সহায়তা।
বছর দুই আগে নেদারল্যান্ডস সফরের সময় একটি অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। লুনটেরে নামক একটি গ্রামে ইয়ান ডির্ক ফান ডার ভোর্ট নামক একজন খামারির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাঁর খামারটির নাম রিমেকার, যা প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক। খামার পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা ইয়ানের। তিনি পূর্বপুরুষের শুধু ঐতিহ্যই সংরক্ষণ করছেন না, পূর্বপুরুষের যে চেতনা, তা-ও রয়েছে তাঁর মাথায়। আজকের দিনের বাণিজ্য চিন্তাকে হিসাবের মধ্যে রেখেই বেছে নিয়েছেন শতভাগ শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় খামার পরিচালনার পথ।
তাঁর খামারে রয়েছে ৯০টি জার্সি জাতের গাভি। আমাদের দেশের গবাদিপশুর খামারিদের মূল সমস্যা পশুর খাবার নিয়ে। তাই তাঁর কাছে জানতে চাই, কী খাবার দেওয়া হয় এই গাভিগুলোকে? ‘ঘাস’—এককথায় উত্তর দিলেন ইয়ান। তারপর একটু থেমে বললেন, ‘শীতের সময়টায় যখন বরফ পড়ে, তখন খড় খেতে দিই। আর বাকি সময়ে মাঠের ঘাসই গাভির খাদ্য।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- কৃষিপণ্য
- মূল্য নির্ধারণ