১০ জুলাই মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সংবাদমাধ্যমগুলো পরের তিন দিনে (১২ জুলাই পর্যন্ত) মোট ১৬ জনের আত্মহত্যার খবর নিশ্চিত করেছে। ফল প্রকাশের প্রথম চার ঘণ্টার মধ্যে আত্মহত্যা করে ৯ জন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো ৯ থেকে ১০ জন চিকিৎসাধীন। তারাও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।
বলে রাখা ভালো, আত্মহত্যার বা আত্মহত্যাচেষ্টার সব খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না। মনে রাখতে হবে, তাদের সবাই কিন্তু অকৃতকার্য নয়। যেমন আশা করেছিল, তেমন ফল হয়নি বলে তাদের অনেকেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। এর আগে কখনোই একযোগে এতজন কিশোরী–কিশোরের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় জিপিএ-৫ না পাওয়া যে কিশোরী ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে, সে তার ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল সে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, বিদ্যালয় থেকে ১৩ জন জিপিএ-৫ পেলেও ফার্স্ট গার্ল সেই তালিকায় নেই। সে ৪ দশমিক ৮৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ফল প্রকাশের দিন কিশোরী ছিল ঢাকায়, বোনের বাসায়। কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে তার মন খারাপ ছিল। পরদিন শুক্রবার বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে যান। এক দিন পর, ১২ জুলাই বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সে আত্মহত্যা করে।
মনে পড়ে বরিশালের কিশোর সর্বজিৎ ঘোষের করুণ কাহিনি। ২০২২ সালের কথা। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সবাই খুব আশাবাদী ছিল; শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধুরা আর সর্বজিৎ নিজেও। সবাই বেশ উত্তেজিত ছিল ফল প্রকাশের দিন সকাল থেকেই। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, একটি বিষয়ে সর্বজিৎ কৃতকার্য হতে পারেনি। তাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়েছিল। আশ্চর্য, হতাশ, ক্ষুব্ধ সর্বজিৎ সবার অগোচরে আত্মহত্যা করে বসে। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষণের পর সংশোধিত ফলাফলে দেখা গেল, সর্বজিৎ ঘোষ কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হয়নি। সে ৪ দশমিক ৬৭ জিপিএ নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
সব সময় যে শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়, তা কিন্তু নয়; সর্বজিৎ ঘোষের মতো ঘটনা অন্যের ক্ষেত্রেও ঘটে। যন্ত্রের ত্রুটি, পরীক্ষকের অসাবধানতার মতো অনেক দুর্ভাগ্যজনক ভুল—যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে পরীক্ষা করা কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়। তারা সত্যিই অকৃতকার্য হয়েছে কি না, তা জানার কোনো সহজ উপায় নেই। তাদের শিক্ষাজীবনের মাঝখানে একটি ছেদ চিহ্ন, মানে পুরো জীবনের সমাপ্তি।
সর্বজিৎ আর কখনো ফিরে আসবে না। ফল প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কি আরও একটু সতর্ক হবেন? শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন হলো, তাঁরা কি পুনর্নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াটি দ্রুত, সহজ ও সহজলভ্য রাখবেন?
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহারিকের নম্বর বোর্ডে পাঠাতে ভুলে গিয়েছিল
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর, যশোরের পুলেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষার পর নেওয়া ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর বোর্ডে পাঠানো হয়নি। পরীক্ষার পরপরই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বোর্ডে এগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা দেখে তারা বাংলা, ইংরেজি, অঙ্কে কাঙ্ক্ষিত নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হলেও অন্য সব বিষয়ে অকৃতকার্য। জীবননগরের হাসাদহ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্র ১০ জুলাই জানায়, ‘সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়েছি, তবু সবকিছু শেষ। কার কী দোষ, আমি জানি না। ভালো পরীক্ষা দিয়েও কেন ব্যবহারিকে ফেল এসেছে, জানি না। বিষয়টি তদন্ত করে সমাধান করা হোক।’ সমাধান চেয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে। একই কারণে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মজিদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ভোকেশনাল শাখার সব পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। যশোরের পুলেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে ৩২৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়।
হতাশ ও বিস্মিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের জেরার মুখে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোর্ডে ব্যবহারিকের নম্বর না পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের কাছে ধরনা দিলে ইউএনও বা শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।