
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দ্বিচারিতা ও নেতানিয়াহুর বিপজ্জনক খেলা
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার কট্টর ডানপন্থি সরকারের একের পর এক উগ্র সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, ইসরাইলের তথাকথিত ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ প্রকল্প, যেটি বাস্তবিক অর্থে একটি আধুনিক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হিসাবেই ব্যাখ্যা করছেন ইসরাইলেরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বহু দশক ধরে ইসরাইলকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তারা একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির কথা বলে, আবার অন্যদিকে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও জাতিগত নিধনের চেষ্টাকে কার্যত প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। এ এক চরম দ্বিচারিতা। যে কারণে গাজা, পশ্চিম তীর, ইরানসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অনিরাপত্তা ও সংঘাতের জালে জর্জরিত হয়ে আছে।
ইসরাইল কাতজের প্রস্তাবিত ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ কার্যত একটি বন্দিশিবির, যেখানে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে ঢোকানো এবং পরে সেখান থেকে তৃতীয় দেশে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এমন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলমার্ট বলেন, ‘এটি জাতিগত নিধনের স্পষ্ট রূপরেখা। এটা কোনো মানবিক প্রচেষ্টা নয়, বরং একটি গণ-বন্দিশিবির তৈরির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিকল্পনা।’ ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক গভীরতর উদ্বেগের বিষয়। বিশ্ব যে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নৃশংসতা দেখেছে, আজ সেই ইসরাইলই এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
নেতানিয়াহু সরকারের এসব পদক্ষেপ শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য বিপজ্জনক নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেই বিপর্যস্ত করে তুলছে। ইরানে সাম্প্রতিক গোপন হামলা এবং সিরিয়ায় একাধিক বিমান হামলা এই সত্যই তুলে ধরে। ইসরাইল এখন এমন এক আগ্রাসীরূপ ধারণ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়েও কার্যত তাদের নির্দেশের তোয়াক্কা করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রতিরক্ষা বিভাগ বারবার সংযমের আহ্বান জানালেও নেতানিয়াহু তার নীতিতে অটল থাকছেন। ইরানে হামলার বিষয়ে হোয়াইট হাউসের অনুমতি না নিয়েই এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা, ভবিষ্যতে বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করছে।
এখানেই আমেরিকার নীতির দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমেরিকা একদিকে আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে ইরান, সিরিয়া বা অন্য দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, অথচ অন্যদিকে ইসরাইল যখন সেই আইন ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা বর্ষণ করে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে বা যুদ্ধাপরাধ করে, তখন তারা মৌন সমর্থন দেয় বা সামান্য বিবৃতি দিয়েই দায় এড়ায়।
এ দ্বিচারিতার ফলাফল ভয়াবহ। প্রথমত, এতে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ চরমভাবে রুদ্ধ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের মধ্যে ‘অহর্নিশ সমর্থন’ পাওয়ার একটি ধ্রুব বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে, যা তাদের গণহত্যা বা জাতিগত নিধনের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। তৃতীয়ত, আমেরিকার এ নীতির কারণে গোটা মুসলিম বিশ্বে মার্কিনবিরোধী মনোভাব আরও উগ্র হচ্ছে, যা সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার পুষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করছে।
ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চায়, তবে তাকে অবশ্যই ন্যায্যতার নীতি অবলম্বন করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যখন জাতিসংঘ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়, তখন তাদের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এ নীতিগুলো শুধু প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়, মিত্রদের প্রতি নয়। ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে, অথচ কোনো বিচার হচ্ছে না। গাজায় শিশুদের ওপর ফসফরাস বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে, চালিয়ে যাচ্ছে গণহত্যা! অথচ নীরবতা বিরাজ করছে। এ নীরবতা এক ধরনের মদদ হিসাবেই বিবেচিত হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ওলমার্ট, যিনি নিজেই শান্তিচুক্তির পক্ষে কথা বলেছেন এবং ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতার জন্য কাজ করেছেন, তিনিও হতাশ। তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বাস করে না। বরং, তারা একদিকে দখল বাড়াতে এবং অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করতে চায়। আর এসব কিছুর পেছনে রয়েছে এক নিঃশব্দ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যা মানবতা ও ন্যায়ের জন্য এক অপমানজনক পরিণতি।
এ সংকটের ভয়াবহতা শুধু ফিলিস্তিন-ইসরাইল সীমাবদ্ধ নয়। ইরানকে লক্ষ্য করে যেভাবে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে, তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৌদি আরব, লেবানন, ইরাক কিংবা সিরিয়া, সবখানেই এ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। যদি এখনই আমেরিকা ও আন্তর্জাতিক মহল ইসরাইলকে সংযত করতে না পারে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট এক বৃহৎ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব গোটা পৃথিবীতে পড়বে।
পরিশেষে বলা যায়, আমেরিকাকে এ দ্বিচারিতা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার ও শান্তির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। শুধু কূটনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। না হলে ফিলিস্তিন, গাজা, ইরান কিংবা গোটা মধ্যপ্রাচ্য কোনো সমস্যারই স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে না। শান্তির পথে যেতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে একমুখী বন্ধুত্ব নয়, বরং বহুপক্ষীয় ন্যায্যতা ও মানবতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। নেতানিয়াহুর একক খেলা বন্ধ না হওয়ায় শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কট্টরপন্থা
- সামরিক আগ্রাসন