আয়তনে ছোট হলেও দেশের সব এলাকার খবর আমরা জানি না। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, জাত্যাভিমান, দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা নব্যউদারপন্থার বাহাদুরি দিয়ে দেশের কিছু এলাকাকে 'দুর্গম', 'প্রত্যন্ত', 'অপর' এবং প্রবলভাবে আড়াল করে রাখা হয়। এইসব এলাকায় অনিয়ম, অন্যায়, দখল এবং দূষণ দৈনন্দিন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেমন, দেশের রামসার স্বীকৃত জলাভূমি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায়ই মেঘালয় পাহাড় থেকে আসা খনি-বর্জ্যের দূষণে মাছ মারা যায়। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো ধীরে ধীরে ফসলি জমিসহ বালিচাপায় পড়ে যাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্র, গণমাধ্যম কিংবা নাগরিক প্রতিক্রিয়া প্রায় পুরোটাই নিশ্চুপ থাকে। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হয়, দেশজুড়ে নিষিদ্ধ কীটনাশক প্রকাশ্যে বিক্রি হয়—এসব ক্ষেত্রেও প্রতিরোধের ভাষা অনুপস্থিত।
বান্দরবানের পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত পরিবেশ-অপরাধ ঘটে চলেছে এবং সেখানেও আমাদের অবস্থান নির্বিকার। উদাহরণস্বরূপ, গত মাসের ২১ জুনের একটি ঘটনা বলতে পারি, সেদিন বনবিভাগ বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার নয়াপাড়া ইউনিয়নের খৈয়াঝিরি মৌজায় ঢুংখি পাহাড়ে ম্রোদের ফলবাগান ধ্বংস করে সেখানে একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস গাছের চারা লাগিয়েছে। অথচ মাত্র এক মাস আগে, ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস প্রজাতির বৃক্ষরোপণ নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এসব আগ্রাসী বা এলিয়েন প্রজাতির গাছ রোপণ করা যাবে না। এরপরও লামা বনবিভাগের অধীন মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আলীকদম বিটে এই ঘটনা ঘটেছে। এখানেই মেনতক ও কাইংওয়াই পাড়ার ছয়টি পরিবারের প্রায় ১২ একর ফলবাগান ধ্বংস করা হয়েছে।
প্রথমে মেনতকপাড়ার ইয়াঙবুং ম্রোর ৫ একর ফলবাগান কেটে ফেলা হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে মেনক্রিং ম্রো, রেংতাং ম্রো, মেনসিং ম্রো এবং অংহ্লা ম্রোর ফলবাগান কেটে ফেলা হয়। একই সঙ্গে কাইংওয়াইপাড়ার দীংওয়াই ম্রোর ফলবাগানও ধ্বংস করা হয়। প্রায় ১২০০টি কলাগাছ, ৩ শতাধিক পেঁপে গাছ এবং কখেশ জাতের আমগাছ কেটে ফেলা হয়।
২৫ জুন উপজেলা প্রশাসন থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হলেও এখনো পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। এমনকি মেনতকপাড়ার বাইলুম ম্রোর বাড়ির পাশের বৌদ্ধ বিহারের চারপাশেও গাছের চারা লাগানো হয়েছে। বনবিভাগের এই কার্যক্রম স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রগাঢ় আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই ম্রো অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানকার পাহাড়, অরণ্য, ঝিরিপথ ম্রো সভ্যতার প্রাচীন স্বাক্ষর বহন করে। ঢুংখি পাহাড়ে ফলবাগান ধ্বংস এবং নিষিদ্ধ প্রজাতির বৃক্ষরোপণ বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। যেসব পরিবারের ফলবাগান ধ্বংস করা হয়েছে, তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক।
একই সঙ্গে মাতামুহুরী বনাঞ্চলে বসবাসকারী ম্রোসহ অন্যান্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বনবিভাগ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান দূরত্ব দ্রুত ঘোচাতে সংবেদনশীল ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর জীবন-জীবিকা এবং লোকায়ত জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার এখনই সময়।