
নির্বাচনি জটিলতা, রাজনীতি ও জোট-ভোটের নয়া সমীকরণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও জনজীবনের সংকট তো আছেই, এর সঙ্গে সর্বাধিক আলোচনা এখন নির্বাচন ঘিরে। যদিও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ এখনও ঘোষণা হয়নি, এজন্য নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন-আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর শোনা গিয়েছিল, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। বিএনপিও একই কথা বলছে এবং তাদের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তা অনুমোদন করে না।
নির্বাচন নিয়ে নানা দিক থেকে টানাপোড়েন চলছে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছে।
নির্বাচন নিয়ে প্রধান বিতর্ক হচ্ছে, নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে—বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে নাকি সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে?
এখন যে পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ভোট হয়, তাতে ভোট গণনা শেষে যিনি সবার চেয়ে বেশি ভোট পান, তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয় এবং কেউ বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে মাত্র এক ভোট কম পেলেও পরাজিত বলে গণ্য হন—এই পদ্ধতিকে বলা হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি)। প্রচলিত এই পদ্ধতির বাইরে সংখ্যানুপাতিক বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন সংক্ষেপে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আলোচনা চলছে।
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তাদের দাবিতে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং আরও কয়েকটি ছোট দলও সমর্থন দিয়েছে। তারা ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসনে আসন বণ্টন করতে চায়, যা বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, কিন্তু বিএনপি এই প্রস্তাবে রাজি নয়।
বিএনপি যদি ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন মেনে নেয়, তাহলে জামায়াতসহ অন্যান্য দলও পিআর পদ্ধতির দাবিতে থেকে সরে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিসহ কিছু দল বহু বছর ধরে ভোটে পিআর পদ্ধতি চালু করার কথা বলে আসছে।
এরপর প্রশ্ন আসছে নির্বাচনটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা? হলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হচ্ছে কিনা? আওয়ামী লীগ নির্বাচন করার মতো অবস্থায় নেই। তারপরও যদি নির্বাচন করতে চায়, পারবে না। কারণ তাদের কার্যক্রম তো এরই মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে কথা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত একটি বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে। আইন ও নৈতিকতার দিক থেকে এটি প্রশ্নবিদ্ধ এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অবস্থা তৈরি করেছে।
আন্তর্জাতিক মহল—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক মহলে এ সিদ্ধান্তে উদ্বেগ ও ক্ষোভ ধ্বনিত হচ্ছে। একইসঙ্গে বলা হয়েছে, দলের নেতাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে—সেটা যৌক্তিক। কিন্তু সাধারণ কর্মীদের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া উচিত। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তা বন্ধ করা অনৈতিক।
ইকোনমিস্ট তাদের লেখায় আরও বলছে, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তাদের এখনও বৃহৎ জনভিত্তি রয়েছে। নির্বাচনে হারলেও সংসদে তাদের উপস্থিতি গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে প্রতিহিংসার বদলে সহনশীলতা ও পুনর্মিলনের রাজনীতি জরুরি।”
এর মানে, জাতীয় নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার ব্যাপারে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে এবং সেটা বাড়ছে। সেটি না হলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এখন দেখার বিষয়, সরকার কী পদক্ষেপ নেবে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে কিনা, ওই সিদ্ধান্ত দেবে নির্বাচন কমিশন। সিদ্ধান্ত তো হয়েই আছে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের মধ্য দিয়ে।
নির্বাচন হবে কিনা এবং হলে কবে? নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ না থাকায় অনেকে নির্বাচনকে অনিশ্চিত মনে করছেন। তার ভিত্তি কী? সম্প্রতি লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানায় হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, “এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কিসের? কী নির্বাচন হবে? এ জন্য আগে নির্বাচনের পরিবেশ অবশ্যই তৈরি করতে হবে।” নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মৌলিক সংস্কার অবিলম্বে প্রয়োজন। আমরা সেই সংস্কারগুলোর কথা বলেছি এবং অবশ্যই আদায় করব। সুষ্ঠু নির্বাচনও ইনশাল্লাহ আদায় করব।”
নিঃসন্দেহে, তিনি এই কথাগুলো বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। আইন-শৃঙ্খলার খারাপ অবস্থা নিয়ে শুধু তিনি নন, নবগঠিত এনসিপিও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইসলামপন্থী দলগুলো থেকেও একই অভিযোগ সামনে এসেছে। তারা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুপযোগী এবং এই অবস্থায় নির্বাচন অনিশ্চিত হতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ঐকমত্য
- নির্বাচন ব্যবস্থা