
দুই চেতনাই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না
জুলাই বিপ্লব শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার নিয়ে। সেই বিষয়টাকে কি আমরা সংবিধানের আলোকে সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান করে পরিপত্র/গেজেট জারি করতে পেরেছি। এ ইস্যুটির সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের প্রদত্ত মাসিক ভাতার প্রসঙ্গটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদত্ত মাসিক ভাতার বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সেটা বাতিল করা অত্যাবশ্যক। মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং তালিকা প্রণয়নের কাজ ১৯৭৫ সালের মধ্যেই সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল। কোটা ও ভাতা প্রদানের বিষয়টি ১৯৭২ সালে অনুভূত হলে সেটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। সংবিধানের আলোকে কোটা ও ভাতার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করা অত্যাবশ্যক।
২. জুলাই বিপ্লব জাদুঘর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে না থাকলে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সেটা শেষ করা অত্যাবশ্যক। হো চি মিন সিটিতে নির্মিত War Museum-কে অনুকরণ করা যেতে পারে।
৩. ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক প্রজাতন্ত্রের সম্পদ লুণ্ঠন, ব্যাংক ডাকাতি, বিদেশে অর্থ পাচার, বৈদেশিক ঋণের যথেচ্ছ অপব্যবহার, ভারতকে বিনাশুল্কে বাংলাদেশের নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে অনেক চুক্তি/MOU স্বাক্ষর, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার এরূপ অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে সর্বস্তরের জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসে। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে চাঁদাবাজমুক্ত এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আগে জুলাই বিপ্লবের চেতনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চাঁদাবাজি বিদ্যমান রেখে স্বৈরাচারমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব নয়।
৪. ১৯৯০-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিকে ব্যবসায়ী এবং RAW-এর খাঁচা থেকে বের করে আনার আবশ্যকতা রয়েছে। তাদের খাঁচা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে তাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক নেতাদের গাড়ি-বাড়ি-অর্থ সহায়তা নেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। ব্যবসায়ী এবং RAW-এর জালে আটকে থাকা রাজনীতি ব্যবসায়ী এবং RAW-এর স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যস্ত থাকবে। এরা অনেকটা খাঁচায় বন্দি ময়না/টিয়া পাখির মতো, যারা মালিকের স্বর নকল করে বুলি আওড়ায়।
৫. সংসদে ব্যবসায়ীদের পেশাভিত্তিক আনুপাতিক হারে প্রাপ্য কোটা নির্ধারণ করে ব্যবসায়ীদের সেই কোটা অতিক্রম করতে দেওয়া যাবে না। কোনো ব্যবসায়ীকে সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করা যাবে না, কারণ ব্যবসায়ী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে তার ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এটা করা না হলে সংসদ এবং সরকার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ৬. ভারত কখনো বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না। পতিত সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ ভারতকে একতরফা সুবিধা প্রদান করে যতগুলো চুক্তি/MOU স্বাক্ষর করেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে বাতিল করা যেতে পারে। ভারত যদি চট্টগ্রাম নৌবন্দর ব্যবহার করতে চায়, তাহলে বিলনিয়া স্থলবন্দরের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিলনিয়া রেলপথ ব্যবহার করে সেটা করতে পারে। এক্ষেত্রে লাওস যেভাবে একটি সড়ক ব্যবহার করে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক নৌবন্দর ব্যবহার করে থাকে, বাংলাদেশ সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। ৭. সীমান্ত সুরক্ষার প্রতি বাংলাদেশকে আরও অধিকমাত্রায় নজর দিতে হবে। ভারতের অনুকরণে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো পুশইনকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। যৌথ মালিকানাধীন অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। ভারতের একগুঁয়েমি অবস্থানের কারণে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা কখনো সম্ভব হবে না। ৮. সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কোনো আবশ্যকতা নেই। বরং সংখ্যা কমানোর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। মহিলা আসনগুলোকে নির্বাচনের আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবা যেতে পারে। সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি ক্রয়ের সুযোগও প্রত্যাহার করা যেতে পারে। সাধারণ ভোটারদের যে সুযোগ প্রদান করা সম্ভব হবে না, সেরূপ সুবিধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে গ্রহণ করা সংসদ সদস্যদের জন্য একটা অনৈতিক কাজ।
৯. বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় প্রবেশ করেছে। দেশে সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত তরুণও রয়েছে। কিন্তু নিয়োগকারীদের পছন্দ হচ্ছে ভারতীয়/শ্রীলংকান। অজুহাত, তারা বাংলাদেশিদের চেয়ে দক্ষ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করতে হবে, অন্যথায় জাতি হিসাবে আমরা তলিয়ে যাব। ১০. বিচার ও পুলিশ প্রশাসন, তথা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শতভাগ নিষিদ্ধ করতে হবে। দলবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। চাকরিবিধি-সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা সংশোধন করে দলবাজিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ১১. বিশ্বব্যাংকসহ সব ঋণ প্রদানকারী সংস্থার কূটকৌশল ও দুর্নীতি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৮-১০ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে বৈদেশিক ঋণের অর্থে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। নতুন প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং গাড়ি ক্রয় শতভাগ বন্ধ করতে হবে। ১২. ১০০ বিঘা এবং ৬০ বিঘা সিলিং বাস্তবায়ন করা না হলে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। ১৩. Hill Tracts Regulation 1900-এর আওতায় পৃথক ভূমি আইনপ্রণয়ন এবং Updating of Hill Tracts Regulation ছাড়া পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী শান্তি আনয়ন করা সম্ভব হবে না।