স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলের সৃষ্টি হতে পারে

যুগান্তর প্রকাশিত: ০৩ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩৬

এ লেখা যখন লিখছি, তখন দিনটি হলো ১ জুলাই ২০২৫। এক বছর আগে ১ জুলাই যে আন্দোলনের সূচনা হয়, তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং আগস্টের ৫ তারিখ স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে জীবনরক্ষা করেন। বাংলাদেশের মানুষ নতুন জীবন খুঁজে পায়। সাড়ে ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের মানুষকে কার্যত দাসে পরিণত করা হয়। মানুষের বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা ও ভোটারাধিকার প্রয়োগ করে সরকার পরিবর্তন করা কিংবা রাখার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে মানুষজন কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে বোবা হয়ে যায়। গুম, খুন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন হঠাৎ ছোঁ-মেরে একজনকে তার পরিবার-পরিজনের সামনে থেকে তুলে নেয়, এরপর তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। হয় তাকে কোনো খাল-বিল অথবা প্রবহমান নদীর মধ্যে গুলি করে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় অথবা গুম করে আয়নাঘরের মতো শ্বাসরুদ্ধকর জিন্দান খানায় বন্দি করে রাখা হয়। আয়নাঘরে বছরের পর বছর ধরে অনেককে আটকে রাখা হতো। তাদের আপনজনরা জানতে পারত না তারা কি বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে?


আয়নাঘরে আটক থেকে বেঁচে থাকা ছিল চরম দুর্বিষহ। আয়নাঘরের বন্দিদের প্রায় সর্বক্ষণ নির্যাতন করা হতো অথবা জ্বালা-যন্ত্রণা করা হতো। কোনো কোনো বন্দিকে নয় বর্গফুটের গুপ্ত সেলে আটক রাখা হতো। এর মধ্যে দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর যারা বেঁচে থাকত, তাদের কথা ভাবতে গেলে বিস্ময়াভিভূত হতে হয়। এত যন্ত্রণা, এত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরও যে মানুষটি বেঁচে থাকত, তার সম্পর্কে বলতে হয় এ মানুষটির জীবনীশক্তি ছিল অদম্য। কোনো উচ্চতর মহৎ আদর্শ না থাকলে কোনো মানুষ এভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। বিচারবহির্ভূত বহুসংখ্যক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের ইতিহাস থেকে কখনই মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। লোকপরম্পরায় জানা গেছে, ইলিয়াস আলীকে হত্যা করে পেট চিরে পাথর ঢুকিয়ে এবং তা বেঁধে কর্ণফুলী নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে মৃতদেহের সঙ্গে পাথর বেঁধে দেওয়ার কৌশলের ফলে মৃতদেহটি আর ভেসে ওঠে না এবং তার হদিস পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এভাবে শেখ হাসিনার শাসনামলে জেল, জুলুম, মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন-নিপীড়নের যে ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, তার সঙ্গে পূর্বেকার কোনো সরকারের আমলে যে নিপীড়ন-নির্যাতন হয়েছে, তার তুলনা চলে না।


তবে ১৯৭১-এর ঘটনাবলি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন মাত্রার। তখন যে ভয়াবহ নির্যাতন হয়েছিল, তার মূলে ছিল স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঙালিদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই এবং তার সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গচ্ছেদ। শেখ হাসিনা নির্যাতন-নিপীড়ন করে সারা দেশে একটি ভীতির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। শেখ হাসিনার কৌশল ছিল ভয়াবহ নিপীড়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেওয়া এবং চুপ করে থাকতে বাধ্য করা। শেখ হাসিনার এই কৌশল কার্যকর হয়েছিল বলেই তিনি সাড়ে ১৫ বছর একটানা দেশের ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। বিরোধী দল কোনো প্রকাশ্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পেলেও পুলিশ, র‌্যাব ও ঘটনা বিশেষে সামরিক বাহিনীর মধ্যকার অনুগতদের ব্যবহার করে দু-চার দিনের মধ্যেই সে আন্দোলন নস্যাৎ করে দিত। ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করার সব সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বিনা ভোটের নির্বাচন, নিশি রাতের নির্বাচন এবং ডামি নির্বাচন করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়। বিনা ভোটের নির্বাচনের সময় ভারত থেকে সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে এরশাদকে নির্বাচনে যোগ দিতে চাপ দেন। এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তাকে র‌্যাব দিয়ে তুলে নিয়ে অসুস্থ বলে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। এ থেকে বোঝা যায়, প্রতিবেশী ভারত, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চায়।



আওয়ামী লীগ যেভাবে ভারতের স্বার্থরক্ষা করে, বাংলাদেশের আর কোনো দলের পক্ষে সে রকম স্বার্থ পূরণ সম্ভব হয় না। শেখ হাসিনার শাসনামলে করিডর-ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশকে কুমড়ার মতো ফালি ফালি করে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পরিণত হয় ভারতের বশংবদ তাঁবেদার রাষ্ট্রে। শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক হলো স্বামী-স্ত্রীর মতো। তিনি আরও বলেছিলেন, ভারতের উন্নতি মানে বাংলাদেশের উন্নতি, বাংলাদেশের উন্নতি মানে ভারতের উন্নতি। এমন নির্লজ্জ বেহায়াপনা আর কী হতে পারে! একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন মানসম্মানের বালাই না মেনে এমন বেহায়াপনা করতে পারে, তখন কোথায় যায় দেশটির সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তা! আমাদের দেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা ভারতপ্রেমে এতই অন্ধ যে, বাংলাদেশ যদি ভারতের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে তারা সবচেয়ে খুশি হবেন।


এই যখন দেশের অবস্থা, যখন দেশের মানুষের মানবিক মর্যাদার চরম অস্বীকৃতি ঘটছিল এবং দেশটিকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তখনই ছাত্রসমাজ শুরু করে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। আন্দোলনের সূচনাতেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। শত-সহস্র ছাত্রছাত্রী কোটাবিরোধী মিছিলে যোগ দেয়। আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার পুলিশ বাহিনীকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। এক রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারি ছাত্রলীগ হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের গুন্ডা-মাস্তানরা যাকে সামনে পায়, তাকেই বেদম প্রহারে ভয়ানকভাবে আহত করে। ছাত্রছাত্রীরা হল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। তারপর আসে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পালা। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিত হয়ে ছাত্রলীগকে পালটা মার দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে ছাত্রলীগের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এমন সময় শেখ হাসিনা মন্তব্য করলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কোটা পাবে না, পাবে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা? এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠল, তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার। শেখ হাসিনার প্রধান শত্রু তার নিয়ন্ত্রণহীন মুখ। এই মুখ দিয়ে যে ভাষা নির্গত হয়, সে ভাষা শেখ হাসিনার তিন পুরুষকে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।


১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটুকাটব্য করেছিলেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে এক ‘অখ্যাত মেজর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। দেশের মানুষ জিয়াকে ভালোবাসতো, এখনো ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসার মানুষটি সম্পর্কে এমন অবাঞ্ছিত মন্তব্য তাদের ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত করেছিল। শেখ হাসিনার মন্তব্যের ফলে নিরপেক্ষ ভোটারদের ভোট ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যায়। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের রাজাকার বলে আখ্যায়িত করার ফলে ছাত্রসমাজ গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিণতিতে আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও দুর্বার। এই আন্দোলন দমন করা সহজ ছিল না। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। প্রাণহরণকারী অস্ত্র ব্যবহার করে। পুলিশের গোলাগুলি এমন মাত্রায় চলে গিয়েছিল যে, তাদের গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে আসে। হেলিকপ্টার থেকে সার্প শুটাররা রাজপথে আন্দোলনের জন্য জমায়েত হওয়া ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে, এমনকি পাকিস্তানের ইতিহাসে সাধারণ গণ-আন্দোলন দমনের জন্য হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের কোনো নজির নেই। 

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও