শিক্ষার মান বাড়বে কীভাবে
আমাদের এক গৃহকর্মীর দাবি, তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, এসএসসি দেননি, তাঁকে যখন আজ সকালে একটি বাংলা পত্রিকার শিরোনাম পড়ে শোনাতে বললাম, তাঁর প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে যখন সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে একজন ছাত্রকে আমার একটি লেখা ক্লাসে পড়ে শোনাতে বলেছিলাম, ইংরেজি লেখাটি পড়তেও দেখি সেই ছাত্রের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। গত সপ্তাহে আমাদের নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বললেন, স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে নতুনভাবে ভর্তি হওয়া কিছু ছাত্রী নাকি নিজের নাম শুদ্ধ করে লিখতে পারছিল না।
সময়ের পরিক্রমায় আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও। কিন্তু এই সংখ্যাবৃদ্ধি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি, যার প্রমাণ উচ্চশিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডে দেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থান। আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে, বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। এমনকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
মফস্সলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের গরুকে ঘাস খাওয়ানো আর ছাত্রদের পড়ানোর মধ্যে প্রাধিকার নির্ণায়নে যেমন সমস্যা হতে শুনেছি, তেমনি নির্বাচনকালীন পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে ব্যাপক কারসাজি, জালিয়াতি আর আপসের সম্মুখীন হতে দেখেছি অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। দীর্ঘকাল ধরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতি শিক্ষার মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন এবং উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম শিক্ষার পরিবেশকে আরও বিষাক্ত করেছে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার গঠিত হলেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে গেছে। উপাচার্যদের অনিয়ম, শিক্ষার্থীদের আবাসন–সুবিধার দাবিতে আন্দোলন এবং শিক্ষক নিয়োগে ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ—এসবই চলমান অস্থিরতার প্রতিফলন।
শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে দল-মতনিরপেক্ষ, একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রশাসনিক বা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার যে নীতি, তা আজও উপেক্ষিত। বিগত সরকারের সময় থেকে উপাচার্য নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের দাবি থাকলেও এ ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটা তাদের দুর্বলতা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা অবশ্য জানা নেই। কুয়েট ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের অভিযোগে আন্দোলন করেন। আন্দোলনের জেরেই সরকার তাদের অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এসব ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে উপাচার্য নিয়োগে সুপারিশ প্রণয়নে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও অনিয়ম-দুর্নীতি অনেক দিন থেকে অব্যাহত রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৬ সালের এক প্রকাশনায় প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ, বিজ্ঞপ্তির বাইরে মাত্রাতিরিক্ত নিয়োগ, পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করাসহ নানা অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। এমনকি আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদে নিয়োগে ৩-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের তথ্যও উঠে আসে ওই প্রকাশনায়। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত ৩০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির নিয়ম অমান্য করছে। দুঃখজনকভাবে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এসব ক্ষেত্রে কোনো সংস্কার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা যায়নি। শিক্ষা-গবেষণার অনুকূল পরিবেশও তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিক্ষার মান