
টিকে থাকার দায়ে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা
স্থানিক নানা যন্ত্রণার মাঝে আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় আপদের মধ্যে বিপদে পড়ার অবস্থা দেশের ব্যবসায়ীদের। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে পারস্য উপসাগরীয় প্রবেশ দ্বার, বিশ্ব অর্থনীতির লাইফ লাইন হরমুজ প্রণালিতে গোলমাল নতুন ধাক্কায় ফেলেছে তাদের। তা শুধু জ্বালানির দাম বৃদ্ধি নয়, গোটা বিশ্বের শেয়ার বাজারে ধসসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম আঘাতের সন্ধিক্ষণ। পৃথিবীর বুকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি জলপথ বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতির সাথে চরম বিপর্যয়ে পড়ার শঙ্কায় দিনাতিপাত করছে ব্যবসায়ীরা। ছোট-বড়-মাঝারি ব্যবসায়ী, দোকানদার, ক্রেতা-বিক্রেতা কারো নিস্তার মিলবে না এ ঝড় থেকে।
ইরান-ইসরাইল সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, যা থেকে মুক্ত থাকবে না বাংলাদেশও। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষত এলএনজি ও পরিশোধিত জ্বালানি তেল। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। এসব দেশের একাধিক কম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। তার ওপর শ্রমবাজার তছনছ হয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশিদের জন্য প্রধান শ্রমবাজার। ইরান ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ওই অঞ্চলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। এরই মধ্যে ইরানে হাজার দেড়েক বাংলাদেশি চাকরি খুইয়েছেন। আশপাশের দেশগুলোতে প্রবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
কোনো দেশের ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীই সরকারের কাছে অর্থ চায় না। তাদের চাহিদা হচ্ছে নীতিসহায়তা। ব্যবসা-বিনিয়োগের পরিবেশ। সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈশ্বিক বাজারে বড় অংশীদারি অর্জন ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চাইলে শিল্প খাতকে সক্ষম রাখা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। কিন্তু, সদ্য পাস করা বাজেটে সেই নমুনা মেলেনি। আয়ের উৎস সৃষ্টিকারী খাতগুলোর উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের মাঝে এ নিয়ে বেশ অস্বস্তি। কাজ তো তারাই করবে, বিনিয়োগও তাদেরই। সরকার দেবে কেবল সহায়তা ও পরিবেশ। সরকার চাইলে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে একটি মধ্যবর্তী কর্মপরিকল্পনা দেয়া অসম্ভব ছিল না। ব্যবসায়ীরা অনেক দিনের উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দাবি কতোটা গ্রাহ্য হয়েছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। বাজেটে এ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা নেই।
অত্যন্ত লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝেও এ নিয়ে তাড়না অনুপস্থিত। তারা নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন। দাবি জানান। কিন্তু, ব্যবসা-বিনিয়োগ বিষয়ে গরজ কম। নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই চার্টার ইত্যাদি জাতীয় এবং ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক নানা ঘটনার তোড়ে তলিয়ে পড়ছে দেশের অর্থনীতির হালদশার তথ্য। অর্থপাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সরকারের নেওয়া চ্যালেঞ্জগুলো মার খাচ্ছে চরম মাত্রায়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্পে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা, বিপুল খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজারে অস্থিরতার মতো পুরোনো সংকটগুলোর একটুআধটু লাগাম টানতে না টানতেই সামনে আসছে আরেকটি। ফুঁসছেন ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা। কোথাও কোথাও শ্রমিক-কর্মচারীরাও। ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে শিল্প খাতে সংকট কেবল প্রকট হচ্ছে। চরম খরা বিনিয়োগ। নতুন কোনো কর্মসংস্থান নেই। বরং ছাঁটাইয়ের তালিকা দীর্ঘ। চাকরি হারিয়ে যোগ হয়েছে নতুন লাখ বেকার।
অর্থনীতির একটা বাজে অবস্থাকে উত্তরাধিকারের মতো সঙ্গী করে ক্ষমতা নিয়েছে সরকার। যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্থনীতির খ্যাতি-জ্যোতি জগৎজোড়া, তার সঙ্গে সহকর্মী হয়ে আছেন দেশসেরা অর্থনীতিবিদেরা, তারা প্রায়ই পেরে উঠছেন না। ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে, কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রা সংকোচন নীতির মাধ্যমে বাজারে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু সেটা সফলতা আনেনি। উল্টো মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলছে। আর বিনিয়োগ কেবল কমছে। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ, মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা নেমেছে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছেন। ব্যবসা না থাকায় মানুষের মধ্যে অর্থের প্রবাহও নেই। তৈরি পোশাক মালিকেরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। সব হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে আরও বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ীদের। সামনে রাজনীতি কোন দিকে যায়, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। আবার কারা ক্ষমতায় যেতে পারে, তা-ও তারা বিবেচনায় রাখছেন। বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ রেটিংয়ের মূল্যায়নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস নেতিবাচক হিসেবেই বহাল থাকছে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সুবর্ণ সুযোগের দেখা পেয়েও সরকার সেভাবে কাজে লাগাতে পারেনি বলে অনেকের অভিমত। বিগত সরকার দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে গেছে, সঠিক হলেও এ তথ্য আর মানুষ বারবার শুনতে চাচ্ছে না। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া করে গোটাবায়ে রাজাপাকসেও দেশ ছেড়ে পালান। অবস্থা অনেকটাই বাংলাদেশের মতো হয়। বিক্রমাসিংয়ের সরকার এক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। ম্যাজিকের মতো বেড়ে যায় দেশটির পর্যটন ও রেমিট্যান্স আয়। বাড়ে শিল্প ও কৃষি খাতের উৎপাদনও। বিশ্বব্যাংকের বেল আউট সুবিধাও নেয়। কিছু সংস্কার, কিছু কর ছাড়-বৃদ্ধি ইত্যাকার নানাবিধ উদ্যোগের মাধ্যমে দেড় বছরের মধ্যেই দেশকে একটি স্বস্তিকর অবস্থানে নিয়ে আসে বিক্রমাসিং সরকার । বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসেও সে ধরনের লক্ষণ নেই। দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি নেই কোনো খাতেই। চোখে পড়ার মতো কার্যক্রম হচ্ছে ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগ টানার জন্য বিশ্ব উড়ে বেড়ানোর খবর। ঘনঘটার বিনিয়োগ সম্মেলনে সুফল আসেনি। শিল্পকারখানা স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না আসায় রাজস্ব আদায় কমেছে। শিল্পকারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের কর-শুল্ক দেওয়ার সক্ষমতা কমেছে। একদিকে ব্যাংকের ঋণ, অন্যদিকে শিল্প-ব্যবসা ঠিকমতো না চলার কারণে তারা মারাত্মক বিপাকে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ব্যবসা
- অর্থনীতি পুনরুদ্ধার