ঔষধি গাছ: বাংলাদেশের সবুজ অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যশিল্পের এক নতুন দিগন্ত

ডেইলি স্টার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২৫, ২০:৩২

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে এক সময় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ঔষধি গাছের উপস্থিতি ছিল এক পরিচিত দৃশ্য। কারো ঠাণ্ডা-কাশি হলে বাসক পাতা সেদ্ধ, কারো হজমে সমস্যা হলে তুলসী। আবার রক্তচাপ বাড়লে অর্জুনের ছাল। এসব ছিল ঘরোয়া চিকিৎসার অমূল্য ভাণ্ডার। এই গাছগুলো শুধু রোগ প্রতিকারের উপকরণ ছিল না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চিত স্থানীয় জ্ঞানের এক বহমান ধারা। কিন্তু আধুনিক ওষুধ শিল্প, শহুরে চিকিৎসা, ফার্মাসিউটিক্যাল বিপ্লবের ফলে বায়োমেডিকেল চিকিৎসার একক আধিপত্য, কৃষিতে একমুখী ফসল নির্ভরতা ও বাণিজ্যিকতার চাপে এই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।


বর্তমানে চিকিৎসা বলতে মানুষ শুধু প্যাকেটবন্দি ট্যাবলেটকেই বোঝে। অথচ, যেসব রসায়ন ও রাসায়নিক উপাদান দিয়ে আধুনিক ওষুধ তৈরি হয়, তার বহু উপাদানের উৎসই প্রাকৃতিক গাছপালা। উদাহরণস্বরূপ, পেইনকিলার হিসেবে ব্যবহৃত অ্যাসপিরিন এসেছে উইলো গাছ থেকে; ক্যানসার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিনক্রিস্টিন পাওয়া যায় 'মাদাগাস্কার পেরিউইঙ্কল' নামক এক ধরনের ফুল থেকে।


তবে আশার কথা, বিশ্ব এখন আবার প্রাকৃতিক চিকিৎসার দিকে ফিরছে। হারবাল ওষুধের প্রতি মানুষের আগ্রহ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও পরিবেশবান্ধব চিকিৎসার চাহিদা নতুন করে আলোচনায় এনেছে ঔষধি গাছভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও শিল্পের সম্ভাবনা। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে এক বড় সম্ভাবনার জানালা—স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশকে একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ।


বাংলাদেশের ঔষধি গাছ: সম্পদের ভাণ্ডার


বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১০০টিরও বেশি উদ্ভিদ নিয়মিতভাবে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন ও মধ্যাঞ্চলের বনাঞ্চল এই উদ্ভিদগুলোর প্রাকৃতিক আবাসস্থল। আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে গারো, সাঁওতাল, খাসিয়া, চাকমা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই উদ্ভিদজ্ঞান এখনো জীবন্ত। তবে বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়ায় এবং প্রজন্মান্তরের জ্ঞান সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় এ সম্পদ এখন হুমকির মুখে।



বিশ্ববাজারে হারবাল পণ্যের উল্লম্ফন: বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?


বর্তমানে বৈশ্বিক হারবাল ওষুধের বাজার প্রায় ৫৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০২৮ সালের মধ্যে এ বাজার প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এরই মধ্যে এই বাজারে সক্রিয়। চীন তাদের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও বাণিজ্যের অংশ করেছে। ভারতও আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, সিদ্ধ ও হোমিওপ্যাথিকে আন্তর্জাতিক মানে তুলে ধরছে। ভারতের আয়ুর্বেদ, চীনের টিসিএম (ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন), দক্ষিণ কোরিয়ার হানবাং চিকিৎসা পদ্ধতি—সবগুলোই নিজ নিজ ঐতিহ্য ও ঔষধি গাছের ওপর নির্ভর করে বহু বিলিয়ন ডলারের বাজার গড়ে তুলেছে।


বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো এখানে ঔষধি গাছের প্রাপ্যতা আছে। কিন্তু এ শিল্পে বিনিয়োগ নেই। অন্তত ১০০টির বেশি ঔষধি গাছের কার্যকারিতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ হয়েছে। ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থায় এসব গাছ ব্যবহার হয় নিয়মিত। বেশ কিছু কোম্পানি যেমন হামদর্দ, সেন্ট্রাল হোমিও, কেয়া কসমেটিকস ও ইউনানি ল্যাবরেটরি ইতোমধ্যেই এই খাতে সক্রিয়। দেশীয় বাজারে আয়ুর্বেদ ও হারবাল ওষুধের মোট বাজার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার। এর বেশিরভাগ কাঁচামাল এখনো ভারত, চীন কিংবা নেপাল থেকে আমদানি করা হয়। অথচ চাহিদা রয়েছে, ক্রেতা রয়েছে এবং যথেষ্ট কাঁচামাল দেশের ভেতরেই চাষ করা সম্ভব। তবে বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এ খাতে এখনো প্রবেশ করেনি। এ নিয়ে গবেষণাও প্রান্তি পর্যায়ে। অথচ আমাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, স্থানীয় জ্ঞান এবং কম খরচের উৎপাদন সক্ষমতা এই বাজারে প্রবেশের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ নেই, তবে হারবাল ওষুধ ও প্রসাধনী রপ্তানিতে বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।


ওষুধ শিল্পে গাছভিত্তিক চিকিৎসার সম্ভাবনা


বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম শক্তিশালী। বর্তমানে প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে এগুলো রপ্তানিও হয়। কিন্তু এই সাফল্যের মধ্যেও হারবাল ওষুধ বা প্লান্ট-বেসড মেডিসিন এখনো মূলধারায় নেই। কিছু ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান পণ্য তৈরি করলেও তা মূলত স্থানীয় বাজারে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, ক্লিনিকাল ট্রায়াল ও আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে এগুলো এখনো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে।


অন্যদিকে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো উদ্ভিদের উপাদান বিশ্লেষণ করে নতুন ওষুধ তৈরি করছে। সেখানে বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান সমন্বয় নেই। জাতীয় পর্যায়ে 'প্লান্ট-বেসড ড্রাগ ডিসকভারি সেন্টার' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন ওষুধের সন্ধান, প্রমাণভিত্তিক ভেষজ চিকিৎসা উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পেটেন্ট অর্জন সম্ভব।


কৃষি ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র


ঔষধি গাছ চাষ একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি এটি গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক গাছের ফলন তিন-চার মাসের মধ্যে হয় এবং রপ্তানিযোগ্য উপাদান সরবরাহ করা যায়। যেমন: তুলসী, বাসক, কালমেঘ, নিম, শতমূলি, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি গাছ সহজে চাষযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন। এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে তা হবে নারী-নেতৃত্বাধীন সবুজ উদ্যোগের পথপ্রদর্শক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনজিওদের যৌথভাবে ঔষধি গাছ চাষে প্রশিক্ষণ, বীজ সরবরাহ ও বাজার সংযোগে কাজ করতে হবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও