বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট
প্রতিবছর ২০ জুন পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বিশ্বজুড়ে বসবাসরত শরণার্থীদের প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশ করা। সৌহার্দ্য মানে কেবল তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই নয়, বরং ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা। শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন তারা মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে কঠিন জীবনযাপনরত শরণার্থীদের এ–ও বোঝানো যে তারা একা নয়, সারা বিশ্ব তাদের সঙ্গে আছে।
পুরো পৃথিবীতে অবস্থিত শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্ব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানুষ ভাগাভাগি করে নিলেও আমরা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে পৃথিবীর অধিকাংশ (প্রায় ৭৩ শতাংশ) শরণার্থীর আশ্রয় হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এই দেশগুলোর অনেকেই তাদের নিজ নিজ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘ সময় ধরে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবন বলতে গেলে একটি হতাশাময়, মর্যাদাহীন, পরিচিতির সংকট এবং অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে কাটে। কেননা আমরা যতই সারা বিশ্বের মানুষের সাহায্য–সহযোগিতার কথা বলি না কেন, শরণার্থীদের সমস্যার তুলনায় সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অপ্রতুল। মৌলিক চাহিদার কিছুটা পূরণের মাধ্যমে শরণার্থীদের সমস্যার কিছু সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা তাদের প্রধান সমস্যা বিশেষ করে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে বেশির ভাগ সময় ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনও এমনই। আমরা জানি যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসবাস বেশ পুরোনো। ২০১৭ সালে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রবেশ করেছে, তাদের বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করেনি। ফলে তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যদিও বাংলাদেশ সরকার তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রধান যে সমস্যা, অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টির কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ফলে তাদের জীবনের দুর্দশা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর দশটা সাধারণ মানুষের যে জীবন, সে জীবন একজন শরণার্থীর নেই। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও নেই, ফলে তাদের অনেক চাহিদাই অপূর্ণ থেকে যায়।
এই দুর্দশা থেকে শিশুদেরও মুক্তি নেই। একটা প্রজন্ম বড় হচ্ছে জাতিগতভাবে পরিচিতির সংকট নিয়ে। এদের সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে জন্ম নেওয়া প্রায় ৩০ হাজার শিশু। এমন লাখ লাখ শিশু কোনো ধরনের আধুনিক সুযোগ–সুবিধা ছাড়াই বড় হচ্ছে। এরা না পাচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, না তারা সামনে দেখতে পাচ্ছে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। মা–বাবার জন্য এক বড় কষ্টের বিষয় হলো, সন্তানদের একটি দিগ্ভ্রান্ত এবং সামাজিক ও জাতীয় পরিচয়হীন অবস্থায় বড় হতে দেখা। এক বিষাদময় ও হতাশাগ্রস্ত প্রজন্ম বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই মানবিক দায় কি কেবলই আমাদের? বিশ্বসভ্যতা কি কিছুই করবে না তাদের জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কোথায় খুঁজব। যদিও শরণার্থীদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতে জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর এক বক্তব্যে উন্নত দেশগুলোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, তারপরও আমরা দেখছি সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থীদের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতার পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রবণতা। এর প্রভাব অবধারিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়বে এবং পড়ছে।
রোহিঙ্গা সংকটকে আরও জটিল করে তোলার পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির দখল ও মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা। রাখাইনে অবস্থিত বাকি রোহিঙ্গারাও নিরাপত্তার অভাব ও জীবন বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। এমন একটা জটিল পরিস্থিতিতে রাখাইনে অবস্থিত জনগোষ্ঠীর জন্য সাহায্য পাঠাতে মানবিক করিডর বা প্যাসেজ বা চ্যানেলের মতো নানাবিধ বিভ্রান্তিমূলক আলাপ-আলোচনাও আমরা বিগত কয়েক মাসে দেখেছি, যা প্রকৃত অর্থে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি।
আমরা যদি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে মানবিক করিডরের উদাহরণ দেখি তাহলে দেখতে পাই যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহিংসতার মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করে শরণার্থী হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে। ইতিমধ্যেই নির্যাতনের শিকার হয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাই বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলার কোনো বিকল্প নেই। অথচ রোহিঙ্গা সংকটের এত বছর হয়ে যাওয়ার পরও আমরা এ বিষয়ে কোনো বিশদ কর্মপরিকল্পনা ও নীতিমালা দেখিনি।
শরণার্থীবিষয়ক নীতি বা পলিসি প্রণয়ন এখন বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি বিষয়, কেননা সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারত থেকেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ঠেলে পাঠানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশের শরণার্থীবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীসহ সব ধরনের শরণার্থী জনগোষ্ঠীর যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা উচিত।