
লন্ডনের সুবাতাস এবং ফলকার তুর্কের বার্তা
লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক, একটি যৌথ ঘোষণা দেশের রাজনীতিতে কিছুটা সুবাতাস নিশ্চয়ই ছড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরির লক্ষণ যখন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তখনই এল নতুন বার্তা—সরকারের ওপর বিশ্বাস রেখে চলবে বিএনপি। বিএনপির দিক থেকে সরকারকে সাদা পতাকা দেখানো হলেও নতুন অস্বস্তির খবর দিচ্ছে এনসিপি ও জামায়াত। লন্ডন বৈঠকে যে ‘বিজয়’ অর্জিত হলো, তা ধরে রাখা যাবে, না নতুন কোনো ঝোড়ো হাওয়া আবার সব এলোমেলো করে দেবে, বিজয় হাতছাড়া হয়ে যাবে—সে প্রশ্নও সামনে আসছে। ৫ আগস্টের পর থেকে জামায়াতের গায়ে যে খোলা হাওয়া বইছিল, তা অব্যাহত না থাকার আশঙ্কা দলটির মধ্যে দেখা দিয়েছে কি? আবার ড. ইউনূসকে বিশ্বস্ত অভিভাবক ভেবে ভবিষ্যতের পথচলার উপায় খুঁজছিল নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। লন্ডনে গিয়ে ড. ইউনূস তারেক রহমানের নতুন অভিভাবকত্ব নেওয়ায় এনসিপির তরুণতুর্কীদের মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। জামায়াত কিংবা এনসিপি যদি এখন নতুন কোনো বাগড়া দেওয়ার ফন্দি আঁটে, তাহলে ইউনূস-বিএনপি বাঁধন কতটা আলগা হবে অথবা অটুট থাকবে, সেটা নিয়ে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা ঠিক হবে না। দেখতে হবে, হাওয়া মৃদুমন্দ বয়, না দমকা বাতাস ওঠে।
আজ বরং অন্য একটি দিকে নজর ফেরানো যাক। জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক সম্প্রতি সংস্থার সদর দপ্তরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের এক স্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করে। ফলকার তুর্কের বক্তব্য শুধু একটি আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক আইন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের এক গভীর পর্যালোচনাও বটে।
এই বক্তব্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করার সুযোগ রেখে আইন সংশোধনের ঘটনায় তাঁর গভীর উদ্বেগ। যখন একটি রাষ্ট্রে আইনের অপব্যবহারে সংগঠনের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার হুমকির মুখে পড়ে, তখন তা কেবল দেশীয় রাজনীতির বিষয় থাকে না; এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোতেও একটি গুরুতর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ফলকার তুর্ক সে প্রশ্নটাই তুলেছেন।
বাংলাদেশে সম্প্রতি জারি করা সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর মাধ্যমে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত’ ব্যক্তি বা সংগঠনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে—যুদ্ধাপরাধসংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। একই সঙ্গে এই দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে প্রশ্ন হলো—এই সিদ্ধান্ত শুধুই আইনি না, রাজনৈতিকও? একদিকে একসময়ের ক্ষমতাসীন প্রধান দলকে এভাবে নিষিদ্ধ করা, আরেকদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা সম্প্রসারণ করে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে
শাস্তির রায় দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া—এসব পরিবর্তনকে ফলকার তুর্ক ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইন প্রয়োগের পথ বেছে নেওয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরিপন্থী। এতে মতপ্রকাশ, সংগঠন গঠন এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার অন্যায্যভাবে সীমিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
ফলকার তুর্ক তাঁর বক্তব্যে এমন এক সময় এই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, যখন বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে এবং জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ সময়সূচি নিয়ে আলোচনা চলছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি অনুপ্রাণিত বোধ করছি যে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপের মাধ্যমে অগ্রগতি অর্জন করছে।’ অর্থাৎ তিনি মনে করছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব এবং সেটিই হওয়া উচিত।