
উদ্ভাবন শোষণ ও বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ
বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক মৌলিক রূপান্তর ঘটছে। প্রযুক্তির প্রসার এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর অভূতপূর্ব বিকাশের ফলে জন্ম নিয়েছে এক নতুন অর্থনৈতিক সংগঠন, যা সমসাময়িক পণ্ডিতদের কাছে ‘প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি’ নামে পরিচিত। এটি কেবল প্রযুক্তিনির্ভর একটি কাঠামো নয়, বরং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিশ্বব্যাপী তাত্ত্বিক পরিসরে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতার গতিশীলতা এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জঁ তিরোল (Jean Tirole), নিক স্রনিজেক (Nick Srnicek), শোশানা জুবফ (Shoshana Zuboff), জোসে ভ্যান ডিজক (José van Dijck) এবং জিওফ্রে পার্কার (Geoffrey Parker ) সহ একাধিক চিন্তাবিদ এ বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী অবদান রেখেছেন। এই তাত্ত্বিক কাঠামোকে যদি বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে বিচার করা হয়, তাহলে প্রতীয়মান হয় একটি অসমতা-নির্ভর এবং অনিয়ন্ত্রিত প্ল্যাটফর্ম-ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সূচনা।
জঁ তিরোলের 'দ্বিমুখী বাজার' ও বাংলাদেশের প্ল্যাটফর্ম
ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ জঁ তিরোল, যিনি ২০১৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির মৌলিক গঠন বোঝাতে ‘দ্বিমুখী বাজার’ বা ’two-sided markets’ ধারণাটি ব্যবহার করেন। ২০০৩ সালে জঁ-চার্লস রোশে (Jean-Charles Roche) এর সাথে যৌথভাবে রচিত গবেষণা প্রবন্ধ “Platform Competition in Two-Sided Markets” (Toulouse School of Economics, France)-এ তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে একটি প্ল্যাটফর্ম দুই বা ততোধিক ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে মূল্য সৃষ্টি করে এবং উভয় পক্ষ থেকেই মুনাফা আহরণ করে। এই বিশ্লেষণ বর্তমান বাংলাদেশের রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ যেমন পাঠাও, উবার, অথবা খাদ্য সরবরাহ সেবা যেমন ফুডপ্যান্ডা—এইসব প্ল্যাটফর্ম বুঝতে সাহায্য করে। এসব প্রতিষ্ঠান যেভাবে গ্রাহক ও সেবাদাতাদের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর সংযোগ ঘটিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে, তা তিরোলের তত্ত্বকে বাস্তব প্রেক্ষিতে প্রতিফলিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, পাঠাও বা উবার একদিকে যেমন যাত্রীদের জন্য দ্রুত ও সহজে পরিবহনের ব্যবস্থা করে, তেমনি অন্যদিকে চালকদের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে। ফুডপ্যান্ডা রেস্তোরাঁগুলোকে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয় এবং গ্রাহকদের ঘরে বসে খাবার পাওয়ার সুবিধা দেয়। এই মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মগুলো উভয় পক্ষ থেকেই সার্ভিস ফি বা কমিশন আদায় করে। তিরোলের তত্ত্ব এই মধ্যস্থতার প্রক্রিয়া এবং বাজারে প্ল্যাটফর্মের আধিপত্য অর্জনের কৌশলকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে। তিনি দেখান যে, কীভাবে প্ল্যাটফর্মগুলো ‘নেটওয়ার্ক প্রভাব’ (network effects) ব্যবহার করে, অর্থাৎ যত বেশি ব্যবহারকারী প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়, তত বেশি তা উভয় পক্ষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মের বাজার শক্তিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
তবে, তিরোলের মডেল শ্রমের শোষণ, ন্যায্য মজুরি কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার মতো প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নেয় না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার বিশাল এবং শ্রম আইন প্রয়োগ দুর্বল, সেখানে প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থান প্রায়শই নিরাপত্তাহীনতা ও শোষণের দিকে ধাবিত হয়। রাইড-শেয়ারিং বা ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মের কর্মীরা স্বাধীন ঠিকাদার হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্য বীমা, ছুটি বা অন্যান্য শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। প্ল্যাটফর্মগুলো কর্মীদের ওপর উচ্চ কমিশন চাপায় এবং কর্মঘণ্টা নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখে। তাই, তিরোলের তত্ত্ব যেখানে প্ল্যাটফর্মের অর্থনৈতিক দক্ষতা ও বাজার গঠনের দিকে আলোকপাত করে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা শ্রমিকদের বঞ্চনার দিকটিকে অস্পষ্ট রাখে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- উদ্ভাবন
- ডিজিটাল বাংলাদেশ