
প্রধান উপদেষ্টার বিলেত সফর বিফল নয়
ব্রিটেনে আবহাওয়া দিয়ে আলোচনা শুরু করা নাকি বেশ প্রচলিত। অধিকাংশ আলাপে আবহাওয়া প্রসঙ্গ আইস ব্রেকার হিসেবে কাজ করে। সেই চিরায়ত রীতির দেখা মিলল শুক্রবারে হাই ভোল্টেজ বৈঠকেও। লন্ডনের যেই বৈঠকের দিকে কার্যত তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশ।
লন্ডন সফররত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের করমর্দনরত কথপোকথনটা ছিল অনেকটা এরকম:
ইউনূস: খুব ভালো লাগলো আজকে।
তারেক: আমার কাছেও খুব ভালো লাগছে। আপনার শরীর ভালো আছে?
ইউনূস: চলছে, টেনে-টুনে চলছে।
তারেক: আম্মা সালাম জানিয়েছেন আপনাকে।
ইউনূস: অসংখ্য ধন্যবাদ। ওনাকেও আমার সালাম দেবেন।
এরপর বসে গিয়ে ডক্টর ইউনূস প্রথমেই আবহাওয়া প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন।
ইউনূস: আবহাওয়াটা খুব ভালো আজকে। যে কয়দিন আমরা আছি, অপূর্ব। লন্ডনে এরকম একটানা পাওয়া।
তারেক: দুপুর নাগাদ বোধহয় আরেকটু গরম হবে। টেম্পারেচর আরেকটু বাড়বে।
ইউনূস: খুব এনজয় করেছি, সামনেই পার্ক, হাঁটার জন্য সুবিধা।
তারেক: হাঁটতে গিয়েছিলেন?
ইউনূস: হ্যাঁ গিয়েছিলাম।
তারেক: একটা জিনিস খুব ভালো এখানে হাঁটার অনেক জায়গা।
এই ছিল সংবাদমাধ্যমে আসা কথপোকথন, যা অধিকাংশজনের পড়া হয়ে এরই মধ্যে। তবে এরপরের আলোচনা যে বাংলাদেশের রাজনীতির আবহাওয়ার নির্ধারক হয়ে উঠেছিল তা বললে অত্যুক্তি হবে না। সামনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আর কাঠামো কেমন হবে কিংবা সামগ্রিক ব্যবস্থা কোন দিকে হাঁটবে সেই উত্তরও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে এই বৈঠকের সূত্র ধরেই।
প্রধান উপদেষ্টার এই বিলেত সফরে, অগোছালো আর আনাড়ি কূটনৈতিক উদাহরণ থাকলেও, রাজনৈতিক বিবেচনায় এটি ছিল ভবিষ্যৎ সমঝোতার সূচনা। হাল বাস্তবতায় তাকালে এই বৈঠক নিঃসন্দেহে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রেখে গেছে, যা ভবিষ্যতের নির্বাচন ও ক্ষমতা বিন্যাসে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এই বৈঠকটি আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, ক্রমেই বাংলাদেশের হাল-নাগাদ রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠছেন তারেক রহমান। তিনি যে শুধু একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা নয়, বরং দেশের একটি সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ গঠনে তার অবস্থান ও সিদ্ধান্ত মুখ্য হয়ে উঠছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটা লম্বা সময় ধরে নির্বাচনের জন্য আগামী ডিসেম্বর থেকে জুন এই ছয় মাসের একটি টাইমলাইন দিয়ে আসছিল। কিন্তু বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো তাতে স্বাগত জানায়নি। বরং সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখে ক্রমেই ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য শক্ত দাবি তুলতে শুরু করে। এই দ্বৈত অবস্থান দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিল। লন্ডনের বৈঠক ও যৌথ বিবৃতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই দুই সময়সীমার মাঝে একটি মধ্যবর্তী সময়কাল, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে কিছুটা সমঝোতার ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এই সময়ে নির্বাচন হলে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির মধ্যে মতপার্থক্য কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।
বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ” আজ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন জনাব তারেক রহমান লন্ডনে সফররত প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে তাঁদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জনাব তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।”
এই বৈঠকের সময় ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, যদি এই সরকার কেবল একটি নির্বাচন পরিচালনা করেই বিদায় নিতে চাইত, তাহলে এত উচ্চপর্যায়ের আলোচনার প্রয়োজন হতো না। বরং এই সরকার নির্বাচনের বাইরেও কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনের বার্তা দিতে চাইছে। হতে পারে বিচারব্যবস্থা, সংসদীয় কাঠামো বা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কারে। এটি যদি কেবল নির্বাচন আয়োজনের বিষয় হতো, তাহলে বোধকরি এতো উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের প্রয়োজন হতো না। শুধু টাইম টেবিল নির্ধারণই এই বৈঠকের মূল এজেন্ডা নয়। অনুমান করা যায়, প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা ছাড়াও একান্ত ঘরোয়া সহযোগীদের মাধ্যমে মতবিনিময় হয়েছে। সেই আলোচনার অনেক দিক এখনো আমাদের অজানা, এবং হয়তো তা প্রকাশও হবে না। তবে সেই আলোচনা বা প্রকৃত সমঝোতার চিত্র নিঃসন্দেহে আঁকা হয়েছে বৈঠকে। সেই সমঝোতা বা মতপার্থক্য হয়তো জানা যাবে না এখনই।
বিএনপির প্রত্যাশা অনুযায়ী ইউনূস কতদূর যাবেন? এই বৈঠক থেকে ফিরে ড. ইউনূস কেমন ভূমিকা নেবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়। বিএনপি বা তারেক রহমান যেসব শর্ত বা প্রত্যাশার কথা বলেছেন, তা কতটা ইউনূস সরকার পূরণ করতে প্রস্তুত, তা বোঝা যাবে বিএনপির পরবর্তী অবস্থান থেকে। আবার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, একটি কক্ষে সংখ্যানুপাতিক হারের সদস্য ইত্যাদি নিয়ে সরকারের অবস্থানের বিবেচনায় বিএনপির সিদ্ধান্তও আঁচ করা যাবে সামনের দিনে। একে কেবল ক্ষমতার হিসাব না ভেবে রাষ্ট্রকাঠামোর অংশগ্রহণমূলক রূপান্তরের চেষ্টাও বলা যায়। বিএনপি এই শর্ত বা প্রস্তাব মানছে কি না, বা আরও কিছু চাওয়ার প্রতিদান তারা পাচ্ছে কি না, এমন ইঙ্গিতও হয়তো ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।
যৌথ বিবৃতির শেষ লাইন ছিল, “সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।” তবে জুলাই সনদ বা বিচার নিয়ে কি ধরনের আলোচনা হয়েছে তাও স্পষ্ট করেনি কোনো পক্ষ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ আসেইনি আলোচনায়।
এই বৈঠককে তাই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কার্যত সমালোচনার মুখেই রেখেছে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী অভিযোগ করেছেন, জনপ্রত্যাশা ছাপিয়ে বিদেশের মাটিতে নির্বাচন নিয়ে বৈঠক করে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, “বিদেশের মাটিতে নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত অভ্যুত্থানের সঙ্গে ‘প্রতারণা’। আবার হাসনাত আবদুল্লাহ তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন এই বৈঠককে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখতে চান। জাতীয় ঐকমত্যের বিবেচনায় এমন সুসম্পর্ক প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু একইসঙ্গে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তার মতে, এই বৈঠকে নির্বাচন ও তারিখ যতটা গুরুত্ব পেয়েছে সংস্কার ও বিচার সেই গুরুত্ব পায়নি। বোঝা যাচ্ছে এনসিপি বৈঠকের কলেবর নিয়ে খুশি নয়। কিন্তু তাদের এই অখুশি হওয়া কতটা প্রভাব রাখতে পারবে, সেই উত্তর সময়সাপেক্ষ। কারণ সমঝোতা এখন গড়ে উঠছে মূল ক্ষমতার দুই সম্ভাব্য কেন্দ্রের মধ্যে।