
নারী নির্যাতন : পরিবারই সহিংসতার অদৃশ্য কারখানা
পলাশ সাহার আত্মহত্যা হয়তো একটি ব্যক্তিগত ঘটনা, কিন্তু এর পেছনে যে মনস্তত্ত্ব ও মূল্যবোধ কাজ করেছে, তা একেবারেই ব্যক্তিগত নয়। এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা, অবজ্ঞা এবং অবিচারকে অনেকাংশে ‘স্বাভাবিক’ করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু সমাজে নারীরা শুধু স্বামী নয়, বরং শ্বশুরবাড়ি, এমনকি নিজের পরিবার থেকেও নানাবিধ শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক নির্যাতনের শিকার হন। সমাজের নীরব সহমতের বিরুদ্ধে জাগরণের সময় এখন।
নারীর নির্যাতনের বহুমাত্রিক রূপ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, নারী নির্যাতন মানেই শুধু মারধর নয়। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নারী শিকার হন মৌখিক অবমাননা, যৌন হয়রানি, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, চলাফেরার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং মানসিক নির্যাতনের। এই নির্যাতনের উৎসস্থল পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় নীতিও হতে পারে। একেকটি নির্যাতন এমনভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ঘটে যে, অনেক নারী তা স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে শেখেন।
পরিবার নারী নির্যাতনের কারখানা বললেও ভুল হবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, নারীর ওপর সহিংসতার অন্যতম প্রধান উৎস পরিবার। অনেক পুরুষ মনে করেন স্ত্রীকে ‘শিক্ষা দেওয়া’, ‘শোধরানো’, কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণে রাখা’ তাঁর অধিকার। এই ধারণাগুলো শিশুকাল থেকেই পরিবারে গেঁথে দেওয়া হয়—যেখানে মা, বোন কিংবা দাদি-নানিরাও এ ব্যবস্থার অংশ হয়ে যান। অনেক সময় দেখা যায়, পুত্রবধূর ওপর নির্যাতনের জন্য শাশুড়ি বা দেবর-ননদও পুরুষ সদস্যকে উৎসাহ দেন বা নীরব সহমত পোষণ করেন।
পুরুষের অন্ধ লোভ, চাহিদা এবং আধিপত্যবাদের পেছনে পরিবারেই গড়ে ওঠা মানসিকতা এবং বিকৃত মূল্যবোধ দায়ী। যৌতুক, আর্থিক নির্ভরতা, সন্তান না হওয়া, সন্তান মেয়ে হওয়া ইত্যাদি অজুহাতে নারী নির্যাতন যেন একটি সামাজিক নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া পরিবার কিছু সন্তানকে টার্গেট করে তার বউ, সন্তানের উপর নির্যাতন, অবহেলা, কিংবা যৌতুকের দাবি করে। অনেক সময় দেখা যায় সেই স্ত্রী অধিক যোগ্য, অধিক পরিশ্রমী, অধিক ভালো মানুষ। তারপরও পরিবার তাকে নানারকমভাবে শারীরিক মানসিক অত্যাচার করে থাকে। কখনো কখনো হত্যাও করে।
নারী নির্যাতনের পরিণতি নিয়ে বলতে গেলে, এই সহিংসতা শুধু একজন নারীর জীবনকেই ধ্বংস করে না; তা প্রভাব ফেলে তার সন্তানদের ওপর, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে করে ক্ষতিগ্রস্ত। একটি শিশু যদি প্রতিনিয়ত দেখে তার মাকে বাবার হাতে নির্যাতিত হতে, তবে সে বড় হয়ে বা তো নির্যাতক, না হয় নির্যাতনের শিকার হিসেবে গড়ে ওঠে। এতে সমাজে সহিংসতা ও অসমতার এক বিশৃঙ্খল চক্র জন্ম নেয়।
আইন প্রণয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া উত্তরণের পথ নেই! বাংলাদেশে নারী নির্যাতন দমন আইন (২০০০), পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন (২০১০) সহ একাধিক আইন থাকলেও, সেগুলোর প্রয়োগ অনেকাংশেই অকার্যকর। থানায় মামলা নিতে অনীহা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, সাক্ষীর নিরাপত্তাহীনতা নির্যাতিতা নারীদের নিরুৎসাহিত করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নারী নির্যাতন প্রতিরোধ