
বাজেট কি বাস্তবভিত্তিক, জনকেন্দ্রিক ও সংস্কারমুখী হয়েছে?
২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব। এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। এবারের বাজেটের মোট আকার প্রায় ৭.৯ লাখ কোটি টাকা যা ২০২৪-২৫ বাজেটের (৭.৯৭ লাখ কোটি টাকা) তুলনায় সামান্য কম। বাজেট আলোচনার প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট কেমন।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ
ক) উচ্চ মূল্যস্ফীতি: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৯.৯৪ শতাংশে পৌঁছেছিল, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছে। বর্তমানেও এই মূল্যস্ফীতির ধারার খুব একটা হেরফের লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
খ) ডলার সংকট ও রিজার্ভ হ্রাস: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক সময়ের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে (আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২১ বিলিয়ন ডলার), যা আমদানি সক্ষমতাকে সীমিত করছে। যদিও ডলার সংকট কিছুটা কেটেছে কিন্তু আমাদের অর্থনীতি আমদানি-নির্ভর হওয়ায় রিজার্ভ বাড়ানো এখনও জরুরি।
গ) ঋণের বোঝা: আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের জন্য রাজস্ব বৃদ্ধি ও ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের চাপ রয়েছে। ২০২৫ সালে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে দেশীয় ঋণ ১০ ট্রিলিয়ন এবং বৈদেশিক ঋণ ১০৩.৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১২.৩৮ ট্রিলিয়ন টাকা)। এই ঋণ জিডিপির প্রায় ৩১.৭ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জা পান, চীন ও রাশিয়া আমাদের প্রধান ঋণদাতা। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ ৬০শতাংশ বেড়েছে, এবং ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে— বিশেষ করে আইএমএফের শর্ত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের কারণে।
ঘ) বৈশ্বিক প্রভাব: ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ, জ্বালানি সংকট ও বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যা আমদানি ব্যয় বাড়িয়েছে। আবার পণ্যের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে পণ্যের দামও। পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রভাব ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাবও লক্ষণীয়।
ঙ) দারিদ্র্য ও বেকারত্ব: করোনা মহামারীর পর দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ হয়েছে। পাশাপাশি এবং যুব বেকারত্বও একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৫.৬ শতাংশ চরম দারিদ্র্যে ছিল, যা প্রায় ৩ কোটি ১৭ লাখ দরিদ্র ও ৪ কোটি ১৭ লাখ চরম দরিদ্র মানুষের ইঙ্গিত দেয়। ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলার সংকট ও আর্থিক সমস্যার কারণে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছেছে, যা এক বছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ এই সমস্যাকে আরও জটিল করছে।
এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে জনকেন্দ্রিক নীতি, রাজস্ব বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য কৌশলগত বিনিয়োগ প্রয়োজন।
এবারের বাজেটের মূল উদ্দেশ্য
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের মূল লক্ষ্য হলো সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়ন। এই বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্ মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নিচে বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. রাজস্ব আয়:
প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৯শতাংশ)। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ৪,৯৯,০০০ কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, কর জাল সম্প্রসারণ এবং ভ্যাট হার সমন্বয়ের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
২. ব্যয় পরিকল্পনা:
মোট ব্যয় প্রস্তাবিত হয়েছে ৭,৯০,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ১২.৭শতাংশ)। এর মধ্যে পরিচালন ও অন্যান্য খাতে ৫,৬০,০০০ কোটি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২,৩০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, কারণ ২০১৫ সালের পর বেতন কাঠামো সংশোধন হয়নি।
৩. বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন:
বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২,২৬,০০০ কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬শতাংশ)। এর মধ্যে ১,২৫,০০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস এবং ১,০১,০০০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নির্বাহ করা হবে। ঋণের সুদ পরিশোধে ১,২২,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।