বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদ যেন পরিণত হয়েছে এক অলিখিত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে—যেখান থেকে বিরোধ, অভিযোগ আর অস্থিরতার যেন শেষ নেই। নাজমুল হাসান পাপনের দীর্ঘ শাসনের পর এলেন ফারুক আহমেদ, আর এবার আলোচনার কেন্দ্রে আমিনুল ইসলাম বুলবুল। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি এই পদ মানুষকে বিগড়ে দেয়? নাকি এর ক্ষমতা ও দায়িত্ব এতটাই ভারী যে বিতর্কের সৃষ্টি অনিবার্য?
নাজমুল হাসান পাপন টানা ১১ বছর বিসিবির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট কিছু সাফল্য অর্জন করলেও তাঁকে ঘিরে বিতর্কের ভান্ডারও ছিল সমৃদ্ধ। অর্থ কেলেঙ্কারি, স্বজনপ্রীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক আধিপত্য—সব মিলিয়ে তাঁর শাসনকাল সব সময় আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে। কোচ নিয়োগ থেকে শুরু করে দল নির্বাচন—প্রতিটি স্তরে তাঁর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে বারবার। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দেশত্যাগ ও পদত্যাগ এসব অভিযোগকে আরও জোরালো করে তোলে।
পাপনের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার ফারুক আহমেদকে বোর্ডের হাল ধরার দায়িত্ব দেয়। একজন অভিজ্ঞ ও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে তাঁর আগমনকে অনেকে আশার আলো হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই তাঁর বিরুদ্ধেও অর্থ কেলেঙ্কারির গুরুতর অভিযোগ উঠে আসে। গুঞ্জন ছড়ায়, সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনই ছিল তাঁর বিদায়ের মূল কারণ। তাঁর এই স্বল্পস্থায়ী মেয়াদ আবারও বোর্ডের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যা বিসিবির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।
বিসিবির সভাপতির পদটি নিছক একটি প্রশাসনিক পদ নয়। এটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর একটি অবস্থান। এই পদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা, আর্থিক সম্পদ এবং নীতিনির্ধারণের প্রভাব, যা একে শুধু ক্রীড়া প্রশাসনের নয়, একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করে।
এই বিপুল ক্ষমতা ও আর্থিক লেনদেনই অনেক সময় বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়। বিসিবির আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায়ই অস্বচ্ছ থেকে যায়, যার ফলে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ তৈরি হয়। সভাপতি হিসেবে যিনি আসেন, তিনি কেবল একজন সংগঠক নন, তিনি হয়ে ওঠেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অভিযোগ বা প্রভাবশালী মহলের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা দেখা যায়।
এ ছাড়া বিসিবির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকে না। অনেক সময় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী সভাপতি নিয়োগ বা অপসারণের ঘটনা ঘটে, যা বোর্ডের স্বায়ত্তশাসন ও স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একই সঙ্গে জবাবদিহির ঘাটতির কারণে সভাপতির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম হলেও তার যথাযথ প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়।
এই প্রশাসনিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয় ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের ওঠানামা। বাংলাদেশ দল কখনো কখনো প্রতিভার ঝলক দেখালেও পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ভালো করা দল বা খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রায়ই হতাশ করেন। বিশেষ করে এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে প্রত্যাশা তৈরি হলেও ফলাফল হতাশাজনক হয়। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছে, ফলে প্রত্যাশার চাপও অনেক বেশি।
যখন দল ভালো করে না, তখন শুধু খেলোয়াড়েরাই নয়, বোর্ড কর্মকর্তারাও সমালোচনার মুখে পড়েন। আর বোর্ডের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে সভাপতি তখন সহজেই জনরোষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। বলা যায়, এই পদে বসার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ব্যক্তি যেমন বিপুল ক্ষমতা লাভ করেন, তেমনি তাঁকে বহন করতে হয় এক অদৃশ্য কিন্তু ভারী প্রত্যাশার বোঝা।