
দক্ষিণা-দারিদ্র্য
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল তথা বৃহত্তর বরিশালের উন্নয়ন মাত্রা কম কেন এটা একটা যৌক্তিক প্রশ্ন। এর পেছনের কারণ হিসেবে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার থাকে না। এর বেহাল অবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি অবগত। সে বেহাল চিত্র আবার ফুটে উঠেছে এক বিখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন চৌধুরীর সাড়াজাগানো একটা বইতে: “আমরা বছরে একবার কি দুইবার জলপথে কীর্তিপাশা যেতাম। খুব ছোট বেলায় আমাদের ছয়-দাঁড়ের গ্রিনবোট বা বজরা করে যেতাম। পরে ভাড়া করা কোশ নৌকায়। বরিশাল থেকে কীর্তিপাশা ষোল মাইল। গ্রিনবোটে ওই পথ যেতে পুরো একদিন লাগত, আর দুই-দাঁড়ের নৌকায় আট-দশ ঘণ্টা…।”
এমন করে চলে স্বাধীনতাত্তোর দুই দশক পর্যন্ত। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে আজ এই অঞ্চলে গ্রিনবোট বা দুই-দাঁড়ের নৌকার দেখা মেলে খুব কম। জলে ও স্থলে, সুপ্রশস্ত নদী কিংবা সড়কে, সর্বত্র আধুনিক যান এতদঅঞ্চলের যোগাযোগের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখনো ধান, নদী আর খাল এই তিনে বরিশাল, তবে অতীত থেকে চিত্রটা একটু ভিন্ন বলেই মনে হলো। নদী আর খালের ওপর নির্মিত হয়েছে বড় বড় সেতু; পুরোনো দিনের পরিত্যক্ত রাস্তাগুলোর বেশিরভাগ এখন পুরোদস্তুর পিচ ঢালা পথকে- বোধকরি মহাসড়ক বললেও ভুল হবে না। এমনি করে সময়ের বিবর্তনে এতদ্ অঞ্চলের ‘গহীন’ গ্রাম এখন অনেকটাই কর্মব্যস্ত গঞ্জের রূপ নিয়েছে।
দুই.
এমন অবস্থা শুধু বরিশালেই নয়, আরও অনেক জায়গায়। যেমন: পটুয়াখালী জেলার গ্রামও একসময় ‘গহীন’ গ্রাম ছিল বলে সবার ধারণা। বরিশাল সদর থেকে স্থলপথে সেখানে যেতে ৫০ মাইলের মতো এবং নৌপথে যে দূরত্ব ঢের বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। অথচ বরিশাল সদর থেকে সুদূর ওই গ্রামে যেতে এখন লাগে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। কীর্তনখোলা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সেরনিয়াবাত সেতু। পেরোতেই বাঁ পাশে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আর এপাশ/ওপাশে কৃষি জমির ওপর টানানো অসংখ্য সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। একসময় হয়তো সাইনবোর্ড লেখার প্রয়োজন হয়নি কারণ অনেকটা ‘মূল্যহীন’ জমি তাই কে যাবে দখল করতে?
পুরো খরচটাই যাবে পানিতে। কিন্তু আজ রাস্তা ও সেতুর কল্যাণে সেই দিনের অপেক্ষাকৃত মূল্যহীন জমি এখন মহামূল্যবান সম্পদ। যাই হোক, ওই সেতু পেড়িয়ে একদমে পায়রা নদীর পাড়ে অর্থাৎ লেবুখালী ফেরিঘাটে। তারপর সেখান থেকে একটানে যে কোনো অভীষ্ট গ্রামে। সত্যি কথা বলতে কী এ যেন রাস্তা নয়- সমৃদ্ধির সিঁড়ি।
রাস্তার দুপাশে রিকশা/ভ্যান খুব একটা চোখে পড়ে না তবে সারি সারি মোটরসাইকেল আর টমটমের (ভটভটি) মিছিল চোখ এড়ায় না। ব্যাংক থেকে কিস্তিতে পাওয়া মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করছে উঠতি বয়সের তরুণরা। এমনকি একসময় যারা রিকশা টানত তাদেরও মোটরসাইকেল থেকে দৈনিক উপার্জন ১ হাজার টাকা- নেহাত মন্দ নয়। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছের ছায়া বুঝতেই দিল না যে বাইরে ভ্যাপসা গরম।
তিন.
শুধু মুখ দেখে যে পুরো স্বাস্থ্য চেনা যায় না এ কথাটা বহুকাল পূর্বে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন সম্ভবত সে কথাটাই একটু ঘুরিয়ে বলেছেন তার বিখ্যাত ‘ইকোনমিকস্’ বইয়ের সূচনায়। বইটিতে যে ক‘টা ভুলের প্রতি তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন তার একটি হচ্ছে ‘ফ্যালাসি অব কম্পোজিশন’- যার অর্থ শরীরের একটা বিশেষ অঙ্গকে সব শরীর হিসেবে ধরে নেওয়া। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে প্রায়ই এ ভুলটা করা হয় বলে বোধহয় তার এই সাবধান বাণী।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সেতু নির্মাণ
- রাস্তা সংস্কার