
ম্যান্ডেট নিয়ে বোঝাপড়ার ঘাটতি অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে
জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের ৯ মাসের মাথায় পরিবর্তনের ম্যান্ডেট-সংক্রান্ত বোঝাপড়া ও পরিবর্তনকামী প্রতিটি নাগরিকের মূল আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো আবারও মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা আপাতদৃষ্টে জরুরি হয়ে পড়েছে।
বর্তমান সরকার যে সময়টিতে দায়িত্ব নেয়, তখন বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক শূন্যতা থেকে উত্তরণের আশায় বুক বেঁধেছিল। পতিত স্বৈরশাসনের ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলার পতন, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও নীতি সার্বভৌমত্বের বিসর্জন মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিল। সেই ক্ষোভ থেকে উঠে আসে একটি বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রত্যয়। সেখানে ছাত্র–জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনীরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সম্মিলিত প্রত্যয়ে গড়ে ওঠে নতুন এক ম্যান্ডেট। সেটি উৎসারিত হয়েছিল একটি রক্তাক্ত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে।
‘ম্যান্ডেট’ বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল ও কার্যকর তৎপরতার ওপর নির্ভরশীল। আর ম্যান্ডেটের আসল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ‘জন–আকাঙ্ক্ষা’ ও ‘জনমনস্তত্ত্ব’। এ কথা ভুলে গেলেই বিপত্তি। কেননা তখন নাগরিকের সঙ্গে সরকারের পার্থক্যের প্রাচীর বড় হতে থাকে।
এই ম্যান্ডেট তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত, একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণ; দ্বিতীয়ত, কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং তৃতীয়ত, জনগণের বিশ্বাস পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি কার্যকর ও পক্ষপাতমুক্ত প্রশাসনিক উপস্থিতি। এর কোনো লিখিত দলিল ছিল না; বরং ছিল একটি যৌথ উপলব্ধির রাজনৈতিক চুক্তি। সেটাকে আমরা একটি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি বলতে পারি।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই ম্যান্ডেট আজ একেকজনের কাছে একেকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, যা জাতীয় ঐক্যের চেতনাকে ভেঙে দিচ্ছে। কোনো পক্ষই এককভাবে এই ম্যান্ডেটের দাবিদার নয়। এটি এসেছে জনতার কণ্ঠস্বর থেকে, যেখানে রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ ও সশস্ত্র বাহিনী একযোগে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ম্যান্ডেটের একটি মুখ্য অনুষঙ্গ ছিল কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এটি নিছক প্রশাসনিক পরিমার্জন নয়, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে পুনর্নির্মাণের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সংস্কার-প্রক্রিয়া এখন এক গভীর ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। সরকার বিভিন্ন কমিশন, শ্বেতপত্র কমিটি, টাস্কফোর্স এবং পরামর্শ সভার মাধ্যমে একটি আমলাতান্ত্রিক কর্মকৌশল নির্মাণ করেছে ঠিকই কিন্তু বাস্তবতার জমিনে সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। সংস্কার শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বত্র, কিন্তু তার কার্যকরী রূপ ও অগ্রাধিকার বিষয়ে রয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। সংস্কার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েও একধরনের দোদুল্যমানতা দেখা যাচ্ছে। সেখানে অদক্ষতার ছাপ সুস্পষ্ট। ‘সংস্কার প্রকল্প’ জনপরিসরের যুক্ত করার অর্গানিক কাঠামোগত উদ্যোগও অনুপস্থিত। ‘জন–আকাঙ্ক্ষা’র সঙ্গে তার কোনো জোরালো মিথস্ক্রিয়াও দৃশ্যমান নয়।
রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে মাত্র কয়েকটি প্রশ্ন। যেমন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে আনা যায়, সংসদ কতটা কার্যকর হবে, সংসদীয় সংস্কার কেমন হবে। অথচ গত দেড় দশকের স্বৈরশাসন চারটি স্তম্ভের ওপর নির্মিত হয়েছিল—অতি ক্ষমতায়িত প্রধানমন্ত্রী, এলাকাভিত্তিক ‘এমপি রাজ’, কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে স্থানীয় সরকারকে অধস্তন কর্মচারীতে রূপান্তর এবং স্বৈরশাসনের প্রয়োজনে পুলিশ ও প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডের সার্বিক পতন। শেষোক্ত তিনটি প্রশ্নে সংস্কারের আলোচনা প্রায় অনুপস্থিত।
আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে প্রশাসনিক সংস্কারে। প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কারের যে সুপারিশগুলো এসেছে, সেখানে যথেষ্ট প্রায়োগিক দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অথচ জনগণ তাদের জীবনে রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয় এই প্রায়োগিক স্তরেই। এখানেই স্বৈরশাসনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা জমা হয়। একজন এসপি কেন্দ্রের ইশারায় তাঁর ঊর্ধ্বতনকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেন কিংবা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভোরে তুলে নেওয়া হয় রাজপথে আন্দোলন করার জন্য। সংস্কার যদি এই স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে, তাহলে কাঠামোগত পরিবর্তন ততটা ফলপ্রসূ হবে না।
সংস্কার বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, একাধিক কমিশনের রিপোর্ট দাখিল করা হলেও সেগুলোর ভিত্তিতে সরকার কোন সংস্কারগুলো প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা স্পষ্ট নয়। এখানে রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে কিছু কাজ এগিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন এবং যথাসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারার সংকট সংস্কারকে জনসমক্ষে একটি অলৌকিক প্রক্রিয়ায় পরিণত করেছে। এ ছাড়া সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য একটি অতিমাত্রায় ব্যবহৃত শব্দ হয়ে উঠেছে। অথচ এই ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়াটা অসম্পূর্ণ, সময়সাপেক্ষ ও আমলাতান্ত্রিক করে তোলা হয়েছে। এর ফলে সংস্কার কার্যক্রম বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সংস্কার নিয়ে ক্রমেই জনগণের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাষ্ট্র সংস্কার