
ঈদুল আজহা উৎসবের সামাজিক বৈষম্য
ঈদুল আজহা উৎসব, আনন্দ ও উদযাপনের, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই আনন্দ ও উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যা জন্ম দিয়েছে ঈদুল আজহার একটি অর্থনীতির। সে অর্থনীতির সঙ্গে নানা ব্যক্তির কাজকর্ম জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরোটা সুষম বা সমতাভিত্তিক, এমনটি বলা যাবে না। বরং সেগুলোর স্পষ্ট একটি বৈষম্যের দিকও আছে। উদযাপনের আনন্দে আমরা নানা সময় ঈদুল আজহার বৈষম্যের দিকটা ভুলে যাই।
কোরবানির ঈদের অন্যতম ব্যয় হচ্ছে পশু ক্রয়। এটি এ ঈদের একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল দিক। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোরবানির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ না বুঝে অনেক মানুষই উচ্চ মূল্যে পশু ক্রয়ের একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেন। ফলে বাজারে পশুর মূল্য চড়্ চড়্ করে বাড়তে থাকে। উচ্চতম মূল্যে পশু ক্রয়ের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় যারা নামেন, তারা ভুলে যান যে অসমতার কত বিরাট নগ্ন প্রকাশে তারা নেমেছেন। এর সূত্র ধরেই দেখা যায় যে বাজারে কেউ কেউ কোটি টাকার গরু কিনছেন, আবার কাউকে কাউকে গরুর ভাগ কিংবা একটি খাসি কিনেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকার কারণে বহু মানুষ বাজারে পশুর হাটে প্রবেশাধিকার পায় না।
অসমতার সেই প্রকাশ শুধু পশু ক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার প্রদর্শনীর মধ্যেও ব্যাপ্ত হয়। পাড়ায় বা মহল্লায় প্রতিবেশীদের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কার কেনা কোরবানির পশু কত ভালো ও দামি। ব্যাপারটি এক পর্যায়ে শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ তুলনামূলক বিচারকালে বহু শিশুর ছোট হয়ে যাওয়া মুখ দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। এভাবে বৈষম্যের ধারণা তখনই শিশুমনে প্রোথিত হয়ে যায়।
কোরবানির পশু ক্রয়ের আরেকটি দিক বাজারে পশুর জোগান। এ জোগানের একটি অংশ দেশের সীমান্তের বাইরে থেকে আসে, সুতরাং সেখানে একটি আমদানি প্রক্রিয়ার অর্থনীতি ও তার গতিময়তা জড়িয়ে থাকে। বহু ক্ষেত্রে সে পশু জোগান আসে চোরাপথে। সুতরাং কোরবানির বাজারে পশু জোগানের ক্ষেত্রে কালোবাজার ও চোরাকারবার গজিয়ে ওঠে। কোরবানির পশুর জোগানের আর একটি উৎস হলো দেশজ এবং এ জোগানের পেছনে বিনিয়োগ এবং বছরব্যাপী পরিচর্যার প্রক্রিয়া কাজ করে। যেমন গ্রামীণ কৃষকবধূরা স্বল্পমূল্যে একটি পশুশাবক কেনেন কখনো নিজের জমানো অর্থ দিয়ে, কখনো ঋণ করে। তারপর এক বছর তিনি এ শাবককে খাওয়ায়-দাওয়ায়, আদর-যত্ন করে লালন-পালন করেন। এক বছর পর পশুটি যখন বড়সড় হয়, তখন সেটা উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়। কোরবানির পশু জোগানের এ ব্যষ্টিক প্রেক্ষিতটি গ্রামীণ অর্থনীতি এবং গ্রামের বহু পরিবারের কুশল বর্ধনের পেছনে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের বহু বেসরকারি সাহায্য সংস্থার এ জাতীয় কর্মসূচি রয়েছে।
কোরবানির ঈদের অর্থনীতির একটি বিরাট দিক হচ্ছে চামড়ার বাজার, বিশেষত বিশ্ববাজারে কোরবানির পশুর চামড়া রফতানি। গত বছর বাংলাদেশ ১২২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করেছিল। এর মধ্যে চামড়া রফতানি ছিল মাত্র ১২ কোটি ডলারের। কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করার সময় বহু নষ্ট হয়ে যায়। যদিও কাঁচা চামড়া রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালেই তুলে নিয়েছে, তবু মান সংরক্ষণ না করতে পারায় বহু কাঁচা চামড়া রফতানির সম্ভাবনা নষ্ট হয়। অথচ ভিয়েতনামে দেশের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রফতানির মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে ১৯ গুণ বেশি। অথচ চামড়া সংরক্ষণের ব্যাপারে আরো বেশি মনোযোগী হলে কাঁচা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি থেকে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে।
কোরবানির সময়ে কসাইদের চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে পেশাজীবী নিয়মিত কসাইরা রয়েছেন এবং অস্থায়ী অনিয়মিত কসাইরাও রয়েছেন। কসাইদের মজুরিভিত্তিক এ আয়-অর্থনীতিও ব্যাপ্ত। তবে তার চেয়েও বড় কথা হলো, অনিয়মিত ঋতুভিত্তিক কসাইদের অনভিজ্ঞতার কারণে বহু চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে কি এসব অনিয়মিত কসাইদের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়?
- ট্যাগ:
- মতামত
- উৎসব
- অর্থনীতি
- সামাজিক বৈষম্য