
অনলাইনে আম, রপ্তানিতে সম্ভাবনা
পারফিউম মেকার ইলিয়াস নতুন নতুন সুগন্ধি নিয়ে প্রায়ই আমার অফিসে আসেন। গত সপ্তাহে এলেন একটা খুশির খবর জানাতে। তিনি সুগন্ধি তৈরির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের একটা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। গত ঈদুল ফিতরের আগে তাঁর সুগন্ধি বানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে একটা অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠান দেখেই নাকি ওই প্রতিষ্ঠান তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়েছে। আমার এডিট প্যানেলে বসে ইলিয়াসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। যশোরে আম চাষে তরুণের সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন এডিট চলছিল। এই দেখে ইলিয়াস বললেন, ‘আমারও তো চারটি আমবাগান আছে।’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তাই নাকি!’ তিনি জানালেন, রাজশাহীর বাঘায় তাঁর চারটি আমবাগান থেকে প্রতিবছর ভালো একটা আয় হয়। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। আম পাড়ার আগেই অনলাইনে বুকিং হয়ে যায়। শুধু ইলিয়াস নন, আম নিয়ে এমন বাণিজ্যে নেমেছেন অনেক তরুণ-তরুণী। এ বছর আমের মৌসুম শুরু হয়েছে।
আম—এই একটি শব্দেই যেন মিশে আছে বাঙালির আবেগ, স্মৃতি আর স্বাদ। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক কৃষিনির্ভর অর্থনীতি পর্যন্ত, আম এক অদ্ভুত ধারাবাহিকতায় আমাদের জীবন, সংস্কৃতি ও কৃষিতে গেঁথে আছে। শুধু স্বাদের জন্য নয়, আম আমাদের কাছে রীতিমতো এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
বিশ্ব ইতিহাস ঘেঁটেও আমের অস্তিত্ব ও মাহাত্ম্য খুঁজে পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে যখন আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় পা রাখেন, তখনই তিনি প্রথম দেখেন আমের বাগান। ষষ্ঠ শতকে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ যখন ভারতবর্ষে ভ্রমণে আসেন, তিনিও আমের স্বাদে মুগ্ধ হয়ে দেশে ফেরার আগে আম পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মোগল সম্রাট আকবর ভারতের শাহবাগের দাঁড়ভাঙা এলাকায় এক লাখ আমগাছ রোপণের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল আমবাগান—যার ধারাবাহিকতা এখনো টিকে আছে।
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য তালিকায় আম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে আম উৎপাদনে বিশ্বের সপ্তম স্থানে রয়েছে। এই বিপুল উৎপাদনের পরও রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই পিছিয়ে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে আমের চাহিদা বাড়ছেই। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৯ সালের মধ্যে বৈশ্বিক আম বাজারের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
দুঃখজনকভাবে, এত বড় বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায় নগণ্য। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছিল ৭৮৮ টন আম। কিন্তু পরের বছরই সেই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৮৮ টনে, যা ক্রমান্বয়ে আরও কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়। এই পতনের মূল কারণ শুধু বৈদেশিক নীতি বা প্রতিযোগিতা নয়—বরং আমাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, মান নিয়ন্ত্রণে গাফিলতি এবং একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ীর অনিয়ম।
২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা চেইনশপ ওয়ালমার্টে বাংলাদেশি আমের প্রবেশ ঘটে। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ওই সময় এফএও, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও সাতক্ষীরার হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আম বাছাই করা হয় রপ্তানির জন্য। কৃষকেরা ব্যাগিং পদ্ধতি গ্রহণ করেন, মান নিয়ন্ত্রণে সরাসরি যুক্ত হন এবং এক আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ শুরু হয়।
কিন্তু এ আশার বেলুন হঠাৎ করেই চুপসে যায়। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল কয়েক টন আম পাঠানোর পরই রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটে। সরকারের একটি কোয়ারেন্টাইন বিভাগ হঠাৎ করে এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, অন্য দেশে রপ্তানি করা এক চালানে ফলের মধ্যে ফ্রুট ফ্লাই থাকার অভিযোগে। এতে করে ওয়ালমার্টের সঙ্গে করা বড় চুক্তিটি বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে।