অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা, না দেশের ব্যর্থতা
একটি বাংলা গানের প্রথম কলি এ রকম, ‘আমার বয়স বাড়ে কিন্তু আমি বাড়ি না’। এককথায়, আমার বয়স হলেও আমি অপরিণত থেকে যাই।
বিখ্যাত স্কটিশ লেখক উইলিয়াম ব্যারি তাঁর উপন্যাসে ‘পিটার প্যান’ নামের একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চরিত্র সব সময় শিশুর মতো ব্যবহার করত। তার আশপাশের সবাই পরিপক্ব হলেও সে চিরকাল বালখিল্য ব্যবহার করে মানুষকে আমোদ দিত।
‘পিটার প্যান’ চরিত্রটি পরে ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা হয় এমন একজন ব্যক্তির বর্ণনা দিতে, যিনি পরিপক্বতাতেও বড় হতে চায় না। মানুষটি চিরকাল অপরিপক্ব থেকে যায়, যে দুই বছরের শিশুর মতো আচরণ করে। এই মানুষগুলো কখনোই শৈশবের অহংকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক, অপরিণত পর্যায় অতিক্রম করতে পারে না।
আমি এই উপসর্গকে একটি দেশ বা জাতিকে বর্ণনা করার জন্য প্রসারিত করতে পারি, যদি এটি বর্ণনার সঙ্গে খাপ খায়।
আমি আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশের জন্য এই উপমা টানতে বাধ্য হচ্ছি। সমাজের অবস্থা দেখে মনে হয় না কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দেশে আছে। যে যার খুশিমতো আন্দোলন চালাচ্ছে। তার দাবি নিয়ে হয় অফিস ঘেরাও করছে কিংবা রাস্তা অবরোধ করছে, তার অধিকর্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অপসারণ চাইছে। তাদের কাছে নিজের চাওয়া সবচেয়ে জরুরি, যা এখনই সমাধান করতে হবে। তা না হলে সে ঘেরাও ছাড়বে না, রাস্তায় কাউকে চলতে দেবে না, দরকার হলে আমৃত্যু অনশন করতেও রাজি।
মানুষের আচরণ থেকে বোঝা যায় না যে এটি এমন একটি দেশ, যার বয়স ৫৫ পার হতে চলেছে আর দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আচরণ সেই ‘পিটার প্যান’ চরিত্রের মতো, তারা এত বছরেও বদলাতে পারেনি। প্রতিটি দাবির জন্য তারা তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি চায়। এ দাবির ব্যাপারে কেউ কম যায় না।
ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, পরিবহনশ্রমিক এবং তারপর রাজনীতিবিদেরা যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন, তার উদাহরণ নিন।
দেশ একটি বিশাল আন্দোলনের ময়দানে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠী নিয়ত বিক্ষোভ জানাচ্ছে আর তাদের নালিশের তাৎক্ষণিক সমাধান চাইছে। তারা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নতিস্বীকার করবে না। এটা হয়তো থামত, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা জয়ী হয়েছে এবং তারপর অন্যান্য অসন্তুষ্ট অংশের কাছ থেকে নতুন দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। এ এক অন্তহীন চক্র। কিন্তু কীভাবে এবং কখন এটি শুরু হয়েছিল?
৯ মাস আগে ছাত্রদের দ্বারা শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ আমাদের ইতিহাসের এক অন্যতম রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল, যার ফলে একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সরকার এবং এর সমানভাবে অজনপ্রিয় নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু ৯ মাস আগের অস্থিরতা এখনো শেষ হয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী শাসনের পতনে যে গণস্বস্তি ও আনন্দ উদ্যাপন করা হয়েছিল, তা হয়ে গেল ক্ষণস্থায়ী।
দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগে থাকা জনগণের আশা ছিল, দেশ এক নতুন পথে যাবে। এর পাশাপাশি আরও একটি আশা ছিল, স্বৈরাচারী শাসনের শিকার জনগণ দেশে ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার যত্ন নেবে।
নিজেদের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে অন্যের অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সরকারি ও বেসরকারি ক্যাডারদের মতো নতুন কোনো জুলুমবাজ দল গড়তে দেবে না। অন্তত আন্দোলনের প্রথম দিকে মানুষের আশা তা–ই ছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্দোলন
- বিক্ষোভ
- সরকারের ব্যর্থতা