
সর্বত্র বিক্ষুব্ধ কোলাহল, যমুনা ঘিরে নীরবতা
রমনায় প্রাতর্ভ্রমণ অনেকেরই মতো আমারও দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তেমনই একজন নিত্যভ্রামণিক বন্ধু ২২ মে সকালে তাঁর ফেসবুকে ভিডিওচিত্রসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, রমনাকে ঘিরে, বিশেষ করে মিন্টো রোডসংলগ্ন রমনার পূর্ব পাশে এ রকম সুনসান নীরবতা কোনো দিন দেখেননি। প্রতিদিন সকালে সেই শত শত গাড়ির আনাগোনা, ভ্রামণিকদের ভিড়, ঘোল-মাঠা-ডাব কিংবা দেশীয় ফল-সবজির বিক্রেতা কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। সম্পূর্ণ জনবিরল এলাকাটি। এর কারণ আমরা সবাই জানি, সেখানে যমুনার অবস্থান। এমনিতে যমুনা একটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন। কিন্তু এখন তা অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনও সেখানে। তাই ঢাকা এবং দেশের অন্য অনেক স্থানে বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর যে কোলাহল, তা যাতে যমুনার দ্বারে সরাসরি পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ ব্যবস্থায় এই অভূতপূর্ব নীরবতা।
রমনার ওই ভ্রামণিক যখন ফেসবুক পোস্টটি করছিলেন, তখনো সুনসান নীরব এই অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটির এক কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে কাকরাইল মোড়ে রাতভর অবস্থান করা একদল বিক্ষুব্ধ মানুষ স্লোগান দিচ্ছিল। তারা দুই দিন ধরে সেখানে অবস্থান করছিল বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অধিষ্ঠিত করার দাবিতে। হাইকোর্টের একটি রায়ে ২১ মে তাঁদের সেই দাবি পূরণ হয়েছে। এরপর তাঁরা রাস্তা ছেড়েছেন বটে, কিন্তু তার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ওই দুই উপদেষ্টা অরাজনৈতিক সরকারের মধ্যে থেকে রাজনীতি করছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁদের প্রভাব খাটিয়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত করছেন। তাঁরা এ-ও বলেছেন, ওই পদত্যাগের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে। অর্থাৎ রাজপথে তাঁরা ফিরে আসবে শিগগিরই। এ যেন কোটাবিরোধী আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হওয়ার মতো মিটিকুলাস প্ল্যানের আরেক ধরন মনে হচ্ছে।
কাকরাইল মোড় থেকে এক-দেড় কিলোমিটার এবং যমুনা থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যর খুনিদের গ্রেপ্তার এবং দ্রুত বিচারের দাবি তাদের। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত তারা রাস্তা বন্ধ করেই অবস্থান করেছে। তাদের লক্ষ্য বোধ করি যমুনার সামনে অবস্থান নেওয়া। কারণ, সেখানে অবস্থান নিতে পারলেই দ্রুত দাবি পূরণের নজির তাদের সামনে আছে। একই দাবিতে কয়েকটি জেলা শহরেও ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল করে চলেছে। মনে হয় এটা আরও বিস্তৃত হবে।
জুলাই বিপ্লবীদের দল এনসিপি ২০ মে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করেছিল। তাদের দাবি ছিল, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পুনর্গঠন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। তবে ইসি পুনর্গঠনের আগে বর্তমান ইসির অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। পরের দিন খবর বেরিয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকার তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইসিকে চিঠি দেবে। কিন্তু এই ইসির অধীনে এনসিপি কী করে নির্বাচনে অংশ নেবে! ২২ মে তাদের সমাবেশের কর্মসূচি ছিল যাত্রাবাড়ী এলাকায়। অর্থাৎ তারাও রাজপথে আছে, থাকবে। তবে ইসরায়েল গাজা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও এর বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনের পক্ষে বিস্ময়করভাবে রাজপথ নীরব।
রাজপথ থেকে প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এনবিআরকে বিভক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কয়েক দিন ধরে যে অবস্থান কর্মসূচি চালাচ্ছিলেন, ২২ মে থেকে তা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে পরিণত হয়েছে এবং ২৪ মে থেকে ওই কর্মসূচি দেশের সব রাজস্ব বোর্ডের কার্যালয়ে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরপর ২২ মে বিকেলে আন্দোলনরতদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে একটি স্মারকলিপি দিয়েছে। তারপর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় কি না দেখতে হবে।
এরই মধ্যে ২২ মে খবর এসেছে, অটোপাসের দাবিতে সাড়া না দেওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। শিক্ষকদের বিরোধিতা ও দাবির মুখে পদত্যাগ করেছেন কুয়েটের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য। ভারত পুশ ইন অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ চিঠি চালাচালি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি চুক্তি বাতিল করেছে। বাংলাদেশে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ ১৯৭২ সাল থেকে আমরা ভারতের সঙ্গে গোলামি চুক্তিসহ অনেক অসম চুক্তির কথা শুনে আসছি। আর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এখন বলছেন, ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি বাতিলের পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকে (জিআরএসই) বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি অত্যাধুনিক ‘ওশান-গোয়িং টাগ’ বা বিশেষ ধরনের জাহাজ নির্মাণের অর্ডার দিয়েছিল। সেটি ২১ মে বাতিল করা হয়েছে।