
পদত্যাগ দাবি ভাবনা
উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা এবং আশঙ্কার মধ্যে কাটছে সময়। দেশের রাজনীতি নিয়ে যারা ভাবেন বা খোঁজ রাখেন, তাদের কপালে চিন্তার রেখা ক্রমশ গভীর হচ্ছে। দুটো প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে বারবার। কী হচ্ছে দেশে? এরপর কী হবে? প্রশ্ন দুটো ছোট কিন্তু উত্তর ছোট নয়, সহজ তো নয়ই। গত কয়েক দিন ধরে নানা ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা, পদক্ষেপ ও মন্তব্যের পর গত ২২ মে দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। তৎপর হয়ে হয়ে উঠে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক মহল, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন এই সরকারকে কিংবা বিরোধিতা যারা করছেন সরকারের, তারাও নড়েচড়ে ওঠেন। দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে। অনেকে ছুটে যান যমুনায়, ফেসবুকে মুখর হয়ে উঠেন অনেকে আর রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তি ঐক্যের আহ্বান, ধৈর্যের আকুতি আর বিভাজন দূর করার অঙ্গীকার করেছেন। গভীর রাতে প্রেস সচিবের ফেসবুক স্ট্যাটাস আরেক নতুন সংশয় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সংশয় তো সমাধান নয়, মানুষ জানতে চায়, এই যে অনিশ্চয়তা এর সমাপ্তি কোথায় এবং কোন পথে? গণঅভ্যুত্থানের পর নবগঠিত দল যাদের সরকারের অংশ বা স্নেহধন্য বলে মনে করা হয়, সেই দলের প্রধান ২২ মে রাতে বিবিসি বাংলাকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন।’ এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে দীর্ঘক্ষণ উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্রমতে, ঢাকায় প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। আলোচনার এক পর্যায়ে কাজ করতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, সংস্কারের বিষয়েও এখনো তেমন কিছু হলো না। তাহলে তিনি কেন থাকবেন এমন প্রশ্নও তিনি আলোচনায় আনেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেল, ড. ইউনূস পদত্যাগ করছেন না।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, উপদেষ্টা পরিষদের ওই আলোচনায় উপস্থিত থাকা সূত্রগুলো আরও জানায়, একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা তাদের বলেন, তারা যেন আরেকটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। কারণ তিনি চলে যেতে চান। বর্তমানে যে পরিস্থিতি আছে তাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে, ব্যালট ছিনতাইয়ে মতো ঘটনা ঘটলে পুলিশ-প্রশাসন তা ঠেকাতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। অন্যদিকে ভালো নির্বাচন করতে না পারলে, মানুষ তাকে দায়ী করবে বলেও আলোচনায় উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে আরও কিছু সূত্র উল্লেখ করে যে, বিভিন্ন পক্ষের অসহযোগিতার বিষয়টি জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে তুলে ধরার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। একপর্যায়ে তার ভাষণের একটি খসড়াও তৈরি করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভাষণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে পরে আবার আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, যদি ঠিকভাবে কাজ করতে না পারেন, তাহলে প্রধান উপদেষ্টার পদে থেকে কী লাভ? বিষয়টি আকস্মিক বলে মনে হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে সরকারের ওপর যেমন চাপ বাড়ছে, তেমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত বিক্ষোভেরও জন্ম দিয়েছে। গত কয়েক দিনে ঢাকাবাসী নানা দাবিতে বড় বড় সমাবেশ দেখেছে। প্রায় সব সমাবেশের লক্ষ্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনা। দিন-রাত ঘেরাও করে রাখা, অবস্থান করা এবং দাবি আদায় করে ফিরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। পছন্দের রাজনৈতিক সংগঠনের আন্দোলনে সহায়তা, অপছন্দ হলে মামলা ও গ্রেপ্তার করে হয়রানি, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নিয়ে জটিলতা, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি, উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি, করিডর, বন্দর ও মব ভায়লেন্স এমনকি নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য বলে যা পত্রিকায় এসেছে, তা ক্ষমতাকেন্দ্রে অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থান এক বিপুল জাগরণ ঘটিয়েছিল। মানুষ দেখেছে সাহস, ক্ষোভ আর জীবনদানের দৃষ্টান্ত। অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে যারা ক্ষমতায় এলেন, তারা কি এর মর্যাদা দিয়েছেন? ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক স্বৈরাচারের নামের প্রতি মানুষের ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। ফলে নাম পাল্টে ফেলার ঘটনা ঘটবেই, মানুষ এটা ধরে নিয়েছে। অভ্যুত্থান কোনো শান্তিপূর্ণ ঘটনা নয়। অত্যাচারিত ক্ষুব্ধ মানুষ ভেঙে ফেলতে চাইবে অনেক কিছ। কিন্তু যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তাদের ভূমিকা কী হবে? এটাই ছিল বড় প্রশ্ন। স্থাপনা ভাঙা, মাজার ভাঙা, নারীর ওপর নানা ধরনের উৎপীড়ন, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি এবং সব মিলে মব ভায়লেন্সের যে উৎকট প্রদর্শনী হয়েছে, তাতে দেশের মানুষের মনে ভরসা নয়, ভয়ের শিহরণ তৈরি হয়েছে তা কি অস্বীকার করা যাবে? এর ফলে দ্রুত সমর্থন হারিয়েছে তরুণ-যুবকরা। ঢাকার যে নাগরিকরা বন্যা ত্রাণ তহবিলে উদার হাতে টাকা দিয়েছেন, তাদের ভালোবাসা ও ভরসা কতটুকু ধরে রাখা গেছে? এখন পর্যন্ত দেশপ্রেম মানুষের বড় আবেগের জায়গা। জুলাই অভ্যুত্থানের সেই দুঃসাহসিক আন্দোলনে জাতীয় সংগীত, দেশ ও সংগ্রামের গান গাইতে গাইতে, জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধে যারা নেমে এসেছিল মিছিলে, অভ্যুত্থানের পর যখন তারা শুনতে পেল জাতীয় সংগীত পাল্টানোর কথা, সংবিধান ছুড়ে ফেলার হুমকি, তখন তারা প্রতারিত বোধ করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া, মিয়ানমারের জন্য মানবিক করিডর আর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখ ফসকে কথা বলা কি জনমনে সন্দেহ ও বিতর্ক তৈরি করতে ভূমিকা রাখেনি? এক সময় মবের চাপে বিচারপতি পাল্টানোর দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়েছিল। ফলে আজ আন্দোলন করে হাইকোর্টকে প্রভাবিত করার অভিযোগ আর হাইকোর্ট কী দরকার, এই প্রশ্ন কি আবেদন সৃষ্টি করবে? গত ৯ মাসে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? ক্ষমতাসীন সরকার ও মব সৃষ্টির সহায়তাকারীদের কাছে সেই জবাব কি দেশের মানুষ চাইবে না?
নির্বাচন দিলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে? যারা ক্ষমতায় আসবে তারা তো লুটপাট দুর্নীতি করবেই। এসব কথা এখন কোনো আবেদন তৈরি করছে না। দেশের মানুষ গত দশ মাসে যদি লুটপাট দখলদারিত্বের বিপরীতে শক্ত অবস্থান দেখতে পেত, তাহলে ভরসা পেত, বিশ্বাস করত সরকারকে। কিন্তু দখলবাজি এত বিস্তৃত রূপ নিয়েছে যে, মানুষ এখন দেখছে সব কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে। জায়গা-জমি, হাট, ঘাট, বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত কোথায় দখলবাজি নেই? সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত পেশার সঙ্গে যুক্ত এমন পেশাজীবীদের সংগঠনের নামেও দখলবাজি চলছে। কোনো জবাবদিহি নেই, এমনকি ‘আপনারা এইটা দখল করলেন কেন’ এই প্রশ্ন করার মতো পরিবেশও নেই! তাহলে নির্বাচিতরা দখল ও লুটপাট করবে এই ভয় দেখিয়ে কী লাভ? বরং নির্বাচিতরা কিছুটা জবাবদিহি করবে, অথবা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যাবে। এখন তো দখলের বিরুদ্ধে কিছু বললেই গত ১৫ বছর কী করেছেন, এই প্রশ্নের মুখে পরা কিংবা পতিত স্বৈরাচারের দোসর এমন তকমা পাওয়ার ঝুঁকি আছে। সংস্কার শেষে নির্বাচন কিংবা বিচার শেষে নির্বাচন এসব দাবি নির্বাচনকে দূরে সরিয়ে রাখার লক্ষ্যে করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। কেউ যদি জানতে চায়, নির্বাচন ছাড়া শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কী পথ আছে, তাহলে উত্তর কী হবে? নির্বাচন চাইলেই প্রতিপক্ষ ভাবার কারণ কী?