
হে কিশোর অপরাধী নয় সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে ওঠ
কিশোররা জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ যদি বিপথগামী হয়, যদি কিশোর বয়সে তারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে তবে তা কোনো সমাজের জন্যই শুভ সংবাদ নয়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই কিশোর অপরাধ একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয় বরং একটি বৃহত্তর মানবিক ও সামাজিক সংকট। কিশোর অপরাধ বলতে ১৮ বছরের নিচে কোনো কিশোর বা কিশোরী যখন সমাজবিরোধী, অবৈধ বা অপরাধমূলক কাজে জড়ায়, তখন তাকে কিশোর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন: মাদক সেবন ও বিক্রি, ছিনতাই, চুরি, মারামারি, যৌন সহিংসতা, গ্যাং সংশ্লিষ্টতা, ডাকাতি এবং খুন।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকমাসের অপরাধবিষয়ক ভিডিও ফুটেজ দেখে মানুষের মনে কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন কী করছে না কিছু উঠতি বয়সী কিশোরেরা। এই তো, কয়েকদিন আগে সাভারে একটি মেয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিজের বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সেই খুনের দৃশ্য ভিডিও করে রেখেছে মেয়েটি। এছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মাদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ছিনতাই, খুন হওয়ার দৃশ্য দেখে না কোনো পরিবার শান্তিতে ঘুমাতে পারে, না স্বস্তি পায় আগামীর সম্ভাবনাময় কিশোররা। অনেকের একই প্রশ্ন, কেন এমন হচ্ছে? সন্তানের এমন অবক্ষয়ের জন্য কারা দায়ী?
অভিভাবকদের বিচ্ছিন্নতা, অনুপস্থিতি, সহিংস পরিবেশ বা অতিরিক্ত শাসনের ফলে কিশোরদের মানসিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। কিশোররা সহজেই প্রভাবিত হয়। খারাপ বন্ধুরা, অপরাধে প্রশ্রয় দেওয়া সিনিয়ররা বা আশপাশের অপরাধী চক্র কিশোরদের অপরাধে ঠেলে দেয়। বর্তমানে ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত কিছু গোষ্ঠী শহরাঞ্চলে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্র ব্যবহার, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অনেক কিশোর ভার্চুয়াল গেম, সহিংস ভিডিও, পর্নোগ্রাফি বা অপরাধ উৎসাহিত করে এমন কনটেন্টে আসক্ত হয়ে বাস্তবে তা অনুকরণ করে। দারিদ্র্য, অভিভাবকের কর্মব্যস্ততা বা অবহেলা এবং শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর ঝুঁকি বেশি।
একবার অপরাধে জড়ালে কিশোরটির মানসিক ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সে সমাজে অবজ্ঞার শিকার হয় এবং অপরাধচক্র থেকে বের হতে পারে না। অপরাধী কিশোর পরিবারে কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরিবার লজ্জা এবং অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। একটি সমাজে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিপন্ন। এটা সমাজে নিরাপত্তাহীনতা, অস্থিরতা এবং অসহনশীলতা তৈরি করে। বাংলাদেশে ‘কিশোর গ্যাং’ নামক শব্দটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক আলোচিত। ঢাকার মতো শহরগুলোতে ‘ডন’, ‘টাইটান’, ‘ক্যাসিনো বয়েজ’... ইত্যাদি নামে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। তারা ছুরি, চাপাতি ব্যবহার করে অপরাধে জড়ায়। স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও এদের অংশ হয়। প্রশাসনের নজরদারি বাড়লেও এর মূল শিকড় এখনো সমাজে বিদ্যমান।
শিশুদের মানসিক যত্ন, ভালোবাসা ও সময় দেওয়া, কিশোরদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। বিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষা, সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রম, কাউন্সেলিং ও মনোবিদের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিশোর অপরাধ দমনে কিশোর সংশোধনাগারগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো, পুলিশি হস্তক্ষেপে শিশু-সুলভ আচরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগে কিশোর অপরাধ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। অভিভাবকরা যেন সন্তানদের অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকেন ও প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা তৈরি করেন। কিশোর অপরাধ কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের একক সমস্যা নয়, এটি একটি সর্বজনীন সামাজিক ব্যাধি। সময় থাকতেই আমাদের সচেতন হতে হবে, কারণ একজন কিশোর যখন অপরাধী হয়ে ওঠে, তখন সে কেবল নিজেকে নয়-সমগ্র সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ, দায়িত্বশীলতা ও আন্তরিকতা, যেন কিশোররা অপরাধের নয়-ভালোবাসা, মূল্যবোধ ও স্বপ্নের পথ বেছে নেয়। একজন কিশোর যখন অপরাধের পথে পা বাড়ায় তখন তার পেছনে প্রাথমিক দায়ভার পরিবারের ওপর বর্তায়। কারণ পরিবারের কাছেই শিশুর প্রথম সামাজিকীকরণ ঘটে একজন শিশুর চারিত্রিক গঠন মূল্যবোধ নৈতিকতা সহনশীলতা এবং দায়িত্ববোধ শেখার জায়গা হলো পরিবার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কিশোর অপরাধ