
অন্তহীন নিরাশায় নিমজ্জিত মানবজাতি
আমরা মানবসভ্যতার গর্বিত দোলনায় চড়ে দোল খাচ্ছি। তাহলে এখন সর্বত্র আসল মানুষের সন্ধান করতে হচ্ছে কেন? কারণ বিশ্ব আজ বড্ড দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মানুষকে নিয়েই এ বিশ্ব, মানুষই চরাচর। এ মানুষই সুর-অসুর। অসুরের পদভারে আজ বিশ্ব মথিত, ভয়ে প্রকম্পিত, কুটিল কৌশলে নিষ্পেষিত। এ বিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব যদি না থাকে, বিশ্বটা তখন বিবর্ণ-বিমথিত বা সুবর্ণ শস্য-শ্যামলা-দৃষ্টিনন্দিত হলো কিনা, তাতে মানুষের কী এসে যায়! মানুষ বাঁচে বড়জোর একশ বছর। সময়টা সুন্দর, সুখ-শান্তির সঙ্গে বাসযোগ্য হতে হলে এ বিশ্বে আসল মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে, যারা সুস্থ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী; বিশেষ করে যাদের মুখের কথায়, চিন্তা-চেতনায়, সব কর্মে সাধারণ মানুষ, সব দেশ ও সমাজ নিরাপদ। পক্ষান্তরে রাক্ষস-দানব ও দানবীয় চিন্তা-চেতনা কমাতে হবে। বাস্তবে কি তা হচ্ছে? আসল মানুষ হওয়ার সুশিক্ষা কি তারা আজন্ম পাচ্ছে?
মানুষ কে? মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই কি মানুষ হওয়া যায়? দেখতে মানুষরূপ ধারণ করলেই কি তাকে মানুষ বলা যায়? এখানেই আমরা বড় ভুলটা করে বসি। এ বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানেই সমস্যা। এ ধরনের শতেক প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তরের জন্য কার কাছে যাব! যার মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা নেই, বা আত্মজিজ্ঞাসার ধার একেবারেই ভোঁতা হয়ে গেছে, বিবেকবোধ নিষ্ক্রিয়, পশুত্ব জেগে উঠেছে, তাকে মানুষ না বলে পশু বলাই তো শ্রেয়। পশু পোশাকে সজ্জিত হয় না। পোশাক পরলেই তো মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য এখানেই।
আসল মানুষ হতে গেলে মনুষ্যত্ব আগে থাকা দরকার। মানুষ রূপে জন্মেছি বলেই মনুষ্যত্ব থাকবে, তা নয়। মনুষ্যত্ব বা মানবতাবোধ আছে বলেই আমাদের মানুষ বলা হয়। বিবেক সবসময় জাগ্রত থাকতে হবে। আত্মজিজ্ঞাসাও মানুষ হওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য। আসল মানুষ হতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি এবং প্রতিটি সৃষ্ট জীবের প্রতি অবিমিশ্র মমত্ববোধ একটা আবশ্যকীয় উপাদান। ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানুষ ও জীবের প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি করে এ গুণ থাকাও অপরিহার্য। ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে। এ দুটি গুণও আসল মানুষের মধ্যে থাকতে হয়। এসব গুণ ছোটবেলা থেকে শিক্ষার মাধ্যমে মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হয়। তথাকথিত মানুষের মধ্যে এসব গুণের অভাব আছে বলেই তারা পৃথিবীতে বসেও রকেট ছুঁড়ে প্রকৃতিকে কলুষিত করছে, মানবসভ্যতাকে নিত্য-নতুনভাবে অবিরাম আরও বিপর্যস্ত-নাস্তানাবুদ করে চলেছে। সেক্যুলারিজম মতবাদের ধুয়া তুলে ধর্ম-কর্মের মূল-মানবতার জাগরণ, মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবজাতির কল্যাণ ও ন্যায়নিষ্ঠাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কী না করছি! সূর্যের আলো তো সবার জন্য উন্মুক্ত। কোনো শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা খাটিয়ে সূর্যের আলো পেতে আমাদের যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কেমন হবে? প্রকৃতি প্রদত্ত ধারায় বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে অবিরাম বয়ে যাওয়া নদীর পানি-প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে অন্যের ক্ষতি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অভিন্ন চুয়ান্নটি নদীর পানির এ অবস্থা কেন? এক দেশ অন্য দেশের প্রতি প্রতিহিংসায় মেতে সেদেশকে নিজ স্বার্থে গ্রাস করতে বদ্ধপরিকর হচ্ছে, কোনো প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়কে বোমা মেরে বসতবাটি থেকে সমূলে উচ্ছেদ করে বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিলীন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া ও আমেরিকা কর্তৃক পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান দখল ও অধীন করে সেখানকার খনিজ সম্পদ লুট করার চেষ্টা, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ, পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের নিজ ভূমি থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় উচ্ছেদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নিগ্রহ-অত্যাচার, সিরিয়ার ভ্রাতৃঘাতী প্রতিপক্ষ দমন, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞ-এ হলো হাতেগোনা কয়েকটা উদাহরণ। পরিতাপের বিষয়, ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমগোষ্ঠী জ্ঞাত কারণে নিশ্চুপ। ঘটনাগুলো কত মর্মন্তুদ! মন থেকে ভাবার অবকাশও আমাদের নেই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মানবসভ্যতা