
সংকটের পর কী
এখনই ভারত-পাকিস্তান সংকটের সব দিক পুরোপুরি মূল্যায়ন করা হয়তো একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানা সম্ভব। এর আগে কখনোই দুই দেশ একে অপরের মূল ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালায়নি কিংবা ড্রোনসহ নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি ও অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তারা পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ার পর এর আগে কখনোই এ রকম পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তের এত কাছাকাছি পৌঁছায়নি।
সামরিক সংঘাতের উত্তেজনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চিরাচরিত যুদ্ধক্ষেত্র অধিকৃত কাশ্মীরের গণ্ডি ছাড়িয়ে এবং আগের যেকোনো সংকটের তুলনায় আরও অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে প্রতিরোধ করার সক্ষমতাকে চরম পরীক্ষায় ফেলে। এটি ছিল নজিরবিহীন। তবে যেভাবে এই সংকট প্রশমিত হলো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, তা বহু চর্চিত একটি পদ্ধতি এবং অতীতেও অনেকবার এমনটা হয়েছে।
ভবিষ্যতের জন্য এই সংকটের সামরিক, কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দিকগুলোর একটি মূল্যায়ন করতে হলে সতর্কতার সঙ্গে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এটা বলাই যায়, উভয় দেশ এই সংকট থেকে একেবারেই ভিন্ন ভিন্ন উপসংহার টেনেছে। ভারতের দাবি হলো—যা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন—তাদের সামরিক পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। ভবিষ্যতে যেকোনো সন্ত্রাসী হামলাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এই ‘নতুন’ নীতিমালার অধীনে সামরিকভাবে জবাব দেওয়া হবে।
পাকিস্তান মনে করে, এই সংকটে তাদের সামরিকভাবে জবাব দেওয়ার সক্ষমতা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। কারণ এটাই ভারতকে আরও বড় ধরনের সংঘাতে জড়ানো থেকে বিরত রেখেছে এবং পরমাণু অস্ত্রের ছায়াতলে প্রচলিত যুদ্ধের ক্ষেত্র সম্প্রসারণে ভারতের চেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে। পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক আঘাতে একাধিক রাফাল যুদ্ধবিমান হারানো ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ভারতের মূল ভূখণ্ডে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা পাকিস্তানের প্রচলিত সামরিক শক্তির প্রমাণ দেয়, যা যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে এবং ভারতের ‘সীমিত যুদ্ধ’ নীতিকে নিষ্ক্রিয় করতে সহায়ক হয়েছে।
বাস্তবতা হলো, সংঘাতের মধ্যে ভারত তার সামরিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী মোদি ভিত্তিহীনভাবে ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসের’ দাবি করেছেন। ভারত তার পদক্ষেপের পরিণতি ভুলভাবে হিসাব করেছে। সন্ত্রাসী হামলার প্রতিকারে সামরিক ‘সমাধান’ গ্রহণ তাদের জন্য উল্টো বিপদ ডেকে এনেছে। ভারতের দাবি যে তারা একটি নতুন মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে, তা আসলে বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
ভারতের পক্ষ থেকে যেভাবে বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতে যদি আবার কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে তারা সামরিকভাবে জবাব দেবে—এটি বলা যত সহজ, বাস্তবে ততটাই কঠিন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সংকট নয়াদিল্লির জন্য যে বিব্রতকর ফলাফল বয়ে এনেছে। পাকিস্তানের প্রচলিত প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি নতুন করে বাড়াতে না-ও পারে, তাহলেও অন্তত তারা তাদের প্রতিরোধ সক্ষমতার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরায় প্রমাণ করেছে। ফলে ভবিষ্যতে একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করলে ভারতকে এর জন্য আরও চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। ভারত একটি ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ পেয়েছে, তবে সে যেটি চেয়েছিল, তা তেমনটি নয়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একধরনের অস্থির যুদ্ধবিরতি অবস্থা বিরাজ করছে, যেখানে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। দুই দেশ তাদের সামরিক সংঘাত থেকে একেবারে ভিন্ন ও বিপরীতমুখী উপসংহার টেনেছে এবং শিক্ষা নিয়েছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য ভুল হিসাবের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। বিশেষ করে যদি তাদের মধ্যে স্থায়ী ও কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে না ওঠে।
যুদ্ধবিরতির পর দুই দেশের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনসের (ডিজিএমওস) মধ্যে যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে এই যোগাযোগ শুধু প্রযুক্তিগত বা কৌশলগত পর্যায়ে সীমিত না থেকে আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক ও অনিশ্চিত রয়ে গেছে। বিশেষ করে যখন মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত কেবল ‘সামরিক অভিযান স্থগিত’ করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- যুদ্ধ ও সংঘাত
- ভারত-পাকিস্তান