
পুলিশ জনগণের হবে?
২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর এমন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছে মানুষ যেখানে ন্যায়, নীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। অনেক ঘটনা, অনিশ্চয়তা, বিতর্ক আর বিরোধের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ। যার মূল কথা ছিল ন্যায়, নীতি ও সুশাসনের একটি ভিত্তি গড়ে তোলা। সেই স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জনগণের নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকার। যেখানে প্রশাসন হবে নিরপেক্ষ, পুলিশ হবে জনবান্ধব। জনগণ চেয়েছিল এমন একটি পুলিশি ব্যবস্থা, যেটি রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে কেবল আইন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করবে। দীর্ঘদিন মানুষ দেখেছে, পুলিশ কীভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। পক্ষপাতমূলক গ্রেপ্তার, মামলার অপপ্রয়োগ, প্রতিপক্ষ দমন বা নির্বাচনী সময়ে একচোখা ভূমিকার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে বারবার অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে বড় রদবদলের পথে হাঁটে। বদল হয় প্রশাসনিক কাঠামোতে। উদ্দেশ্য ছিল পুলিশকে দলীয় ছায়া থেকে বের করে, তাদের পেশাদারিত্বের পথে ফিরিয়ে আনা। তবে এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যতটা সহজ, বাস্তবে তার প্রয়োগ ততটা জটিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব রদবদলের পর আদৌ বাংলাদেশ পুলিশ বদলেছে?
যুগ যুগ ধরে পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠেছে শাসক গোষ্ঠীর যন্ত্র হিসেবে। এই বাহিনী যেন এখন রাষ্ট্রের নয় ক্ষমতার। জনগণের সেবক নয় ক্ষমতাসীন দলের দাস। এ দাসত্ব থেকে পুলিশ বেরিয়ে আসবে এমনটা প্রত্যাশা করা হলেও, দেশের যে চিত্র তাতে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয় পুলিশ। একদিকে কিছু সৎ ও পেশাদার পুলিশ সদস্য ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, অন্যদিকে কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ‘ওপরের নির্দেশে’ অপব্যবহার করেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। ফলে গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রচ-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশের ওপর দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন (১) পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং দায়িত্ব বণ্টনে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবমুক্ত একটি নীতি অনুসরণ করে পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। (২) পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নৈতিকতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। তাদের মনে আইন ও ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের সেবার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। (৩) আইন প্রণয়নে পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পুলিশের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন ও কার্যকর জবাবদিহিমূলক কাঠামো তৈরি করা দরকার।
সংবিধান অনুযায়ী, পুলিশ প্রশাসন জনগণের সেবায় নিয়োজিত একটি সংস্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুলিশ প্রশাসন বারবার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তখন আইনশৃঙ্খলা অবনতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতাও তৈরি হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো যখন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করে, তখনই প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে অপরাধ দমনের বদলে অপরাধী রক্ষার একটি চক্র গড়ে উঠেছে আমরা বরাবরই দেখে আসছি, রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার পরিবর্তন এবং কিছু বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শাসক দল প্রায় সবসময় পুলিশকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক সরকার, সেনাসমর্থিত কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবাই কোনো না কোনোভাবে পুলিশের অপব্যবহার করেছে। নির্বাচনের সময় এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়। বিরোধী দলের কর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ, গণগ্রেপ্তার এবং মিথ্যা মামলার দায়ে ফাঁসানোর ঘটনাগুলো দেশের সাধারণ মানুষকে হতাশ করে। পুলিশ প্রশাসনের ওপর এই রাজনৈতিক চাপ কেবল তাদের পেশাদারিত্বকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকেও উসকে দেয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা অপরাধীরা নিরাপদ থেকে যায়, আর এর খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। যখন একটি প্রশাসন দলীয় স্বার্থের অধীনে কাজ করে, তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পুলিশ যখন দলীয় আদেশ পালন করে, তখন তাদের স্বাধীনভাবে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে সঠিক বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় জনগণ। শাসক দলের নির্দেশে কাজ করতে বাধ্য হওয়ার ফলে, পুলিশের নৈতিকতা এবং পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এমনকি সাধারণ মানুষও পুলিশের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। পুলিশ যখন দলীয় স্বার্থে কাজ করে, তখন অপরাধী চক্র সুবিধা নেয়। যার ফলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। পাশাপাশি দুর্নীতি একটি বড় কারণ। যদি পুলিশ প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয় এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকে, তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হবে। নিরপেক্ষ, সেবামুখী এবং জবাবদিহিমূলক পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের ভিত্তি। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব দূর করার জন্য সামাজিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর প্রকট রাজনৈতিক প্রভাব। কোনো রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, ততক্ষণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পুলিশ প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হলে তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের পদোন্নতি কেবল দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত, কোনোভাবেই রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। অপরাধ দমনে পুলিশের কার্যক্রমকে আরও দক্ষ করতে চাইলে প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা পুলিশের চেয়ে বেশি প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন। ফলে অপরাধ তদন্তে পিছিয়ে পড়ে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের ভেতরে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তা তদন্তের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া, পুলিশের কর্মীদের সৎ ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার।
পুলিশ জনগণের সেবক এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন জনগণের আস্থা অর্জন। যখন জনগণ দেখবে যে, পুলিশ কেবল আইনের অধীনে কাজ করছে এবং কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তখনই তারা পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করবে। যে কারণে পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা বাড়ানোর জন্য কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত করা যেতে পারে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। উন্নত দেশে পুলিশ প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খুবই কম। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে পুলিশের কাজের একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে। তারা রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে জনগণের সেবা নিশ্চিত করে। এ ধরনের স্বাধীন পুলিশ প্রশাসন গড়ে তুলতে হলে, আইন সংস্কার করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে পুলিশ কেবলমাত্র আইনের অধীনে কাজ করবে।