
গোধূলি গণতন্ত্র দশা কাটবে তো আমাদের?
গণতন্ত্র সম্পর্কে মজার একটা কথা মনে পড়ল। কথাটা বলা হয়েছিল ব্রিটিশের দেওয়া প্রথম গণতন্ত্রকে উপহাস করে। আর তা বলেছিলেন এ ব-দ্বীপরাষ্ট্রের আমাদের নেতারা রাতদিন মুখে মুখে যে দ্বীপরাষ্ট্রটার সমান (উন্নয়নে) হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে থাকেন, সেই আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা পিতা লি কুয়ান ইউ। তখনো তিনি প্রতিষ্ঠাতা পিতা হননি। ব্রিটিশের নাগপাশ থেকেই পুরোপুরি মুক্ত হয়নি তখনো সিঙ্গাপুর। রেন্ডেল কমিশনের সুপারিশে সেখানে তখন সবে শুরু হয়েছে ব্রিটিশের দেওয়া অভ্যন্তরীণ আধা-স্বরাজ (Partial internal self-government)। ৩২ আসনের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ২৫টি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত, যাদের মধ্য থেকে একজন ছিলেন সরকারপ্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী (চিফ মিনিস্টার)। অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় ব্রিটিশ রেখেছিল নিজের হাতে। সেই সঙ্গে হাতে রেখেছিল অ্যাসেম্বলিতে পাশ করা আইনে ভেটো মারার ক্ষমতাও। লেবার ফ্রন্টের ডেভিড মার্শাল তখন চিফ মিনিস্টার। আর লি কুয়ান ইউ তখন বিরোধীদলীয় নেতা।
ব্রিটিশের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তানের যখন সাত বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছিল তখন, ১৯৫৪ সালের ২১ নভেম্বর ৩১ বছর বয়সি লি কুয়ান ইউ গঠন করেন সিঙ্গাপুরের ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’ (পিএপি), নিজে হন সেই পার্টির সেক্রেটারি-জেনারেল। ১৯৫৫ সালের ২ এপ্রিল ব্রিটিশের দেওয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘পার্সিয়াল ইন্টারনাল সেল্ফ-গভর্নমেন্ট’। এ নির্বাচনের পরে লি কুয়ান ইউ হন বিরোধীদলীয় নেতা। ওই বছরের ২৩ এপ্রিল থেকে হক-লি সম্মিলিত বাস কোম্পানির শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করে। কেমব্রিজ-গ্র্যাজুয়েট লি কুয়ান ইউ প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টারও ছিলেন এবং সেই সুবাদে ছিলেন সিঙ্গাপুর বাস শ্রমিক ইউনিয়নের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার। লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসাবে তিনি বাস শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার বিষয়টি আপস-মীমাংসার জন্য তখনকার সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ভন্ডুল হয়ে যায় বাস কোম্পানির গররাজির কারণে। ১ মে শ্রমিক দিবসে ধর্মঘটী বাস শ্রমিকদের জমায়েতে বক্তৃতায় তিনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সরকারের সমালোচনায় তখনকার গণতন্ত্রকে বিদ্রুপ করে বলেন, ‘হাফ-পাস্ট সিক্স ডেমোক্রেসি’ (Half-past six democracy)। অর্থাৎ, শুধু নামেই গণতন্ত্র-জনগণের ক্ষমতা বা অধিকার, অংশগ্রহণ, ন্যায়বিচার-এসবের খবর নেই।
তখনকার প্রশাসন বা শাসনব্যবস্থার আধা-আধা, দুর্বল, অনির্দিষ্ট ও অকার্যকর গণতন্ত্রকে বোঝাতে লি রূপকার্থে এই ‘হাফ-পাস্ট সিক্স ডেমোক্রেসি’ মেটাফরিক্যাল ফ্রেজ বা বিদ্রুপাত্মক বাগধারাটি ব্যবহার করেছিলেন। বাংলা তর্জমায় একে আমরা ‘গোধূলি গণতন্ত্র’ বলতে পারি। কেননা, ইংরেজি ‘হাফ-পাস্ট সিক্স’ মানে তো বিকাল সাড়ে ৬টাকে বোঝায়, বাংলায় আমরা যেটাকে বলি গোধূলি বেলা। বেলা শেষে দিনের আলো ক্রমেই ম্লানায়মান। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর ডেমোক্রেসিকে তো আমরা গণতন্ত্র বলেই জানি, যার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য নির্বাচন। সুতরাং, নির্বাচনসর্বস্ব নামকাওয়াস্তের গণতন্ত্রকে আমরা ব্যঙ্গ করে রূপকার্থে বাংলায় ‘গোধূলি গণতন্ত্র’ বলতে পারি নিঃসংকোচে।
আমাদের এখানে যখন স্বাধীন পাকিস্তানের এক যুগ (১২ বছর) পূর্ণ হতে চলেছে, তখন ব্রিটিশের কাছ থেকে (ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ‘দ্য স্টেট অব সিঙ্গাপুর অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর অধীনে) সিঙ্গাপুর পায় ‘অভ্যন্তরীণ পূর্ণ স্বরাজ’ (Full internal self-government)। ৫১ আসনের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সব আসনই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। ১৯৫৯ সালের ৩০ মে-এর নির্বাচনে লি কুয়ান ইউয়ের পার্টি পিএপি ৪৩ আসন পেয়ে গেলে লি কুয়ান ইউ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হন সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যপ্রধানের পদবি গভর্নর বদলে ব্রিটিশ করেছিল ‘ইয়াং ডি পারটুয়ান নেগারা’ (কার্যত ব্রিটিশের ভাইসরয়)। গভর্নর স্যার উইলিয়াম গুডি সেই বছরের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘ইয়াং ডি পারটুয়ান নেগারা’ হিসাবে দায়িত্ব পালন করে বিদায় হলে সিঙ্গাপুরের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ইউসফ ইসহাককে করা হয় ‘ইয়াং ডি পারটুয়ান নেগারা’। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় থেকে যায় ব্রিটিশেরই হাতে।
এরপর লি কুয়ান ইউ ১৯৬২ সালের ১ সেপ্টেম্বর গণভোট দিয়ে গণরায় নিয়ে চুক্তি করে ১৯৬৩-এর ১৬ সেপ্টেম্বর স্বাধীন রাজ্য হিসাবে সিঙ্গাপুরকে নবগঠিত মালয়েশিয়া ফেডারেশনে (মালয়, উত্তর বোর্নিও তথা সাবাহ, সারাওয়াক ও সিঙ্গাপুর নিয়ে গঠিত হয়) একীভূত করেন। এর আগে ৩১ আগস্ট (১৯৬৩) ব্রিটিশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২১ সেপ্টেম্বর (১৯৬৩) আগাম নির্বাচন দিয়ে আবারও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হন। এক বছর দশ মাস চব্বিশ দিন মালয়েশিয়া ফেডারেশনে একীভূত থেকে ১৯৬৫-এর ৯ আগস্ট সেখান থেকে বের হয়ে এসে স্বাধীন ‘রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুর’ ঘোষণা করেন। সাত সাতটি নির্বাচনে জিতে ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত টানা ৩১ বছর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী থেকে ৬৭ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় সেই পদ ছেড়ে দিয়ে উপদেষ্টা হিসাবে ‘সিনিয়র মিনিস্টার’ পদে ক্যাবিনেটে থাকেন ডিসেম্বর ২০০৪ পর্যন্ত। পার্টির সেক্রেটারি-জেনারেলের পদ ছাড়েন ১৯৯২ সালের ২ ডিসেম্বর। ২০০৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ পর্যন্ত থাকেন ‘মিনিস্টার মেন্টার’ হিসাবে। নানা অসুখে ভুগে শেষে ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ ৯১ বছর বয়সে মারা যান নিউমোনিয়ায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণতন্ত্র রক্ষা