
ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের ‘গুপ্ত’ রহস্য
‘People always fear change. People feared electricity when it was invented, didn’t they? People feared coal, they feared gas-powered engines... There will always be ignorance, and ignorance leads to fear. But with time, people will come to accept their silicon masters’- Bill Gates
এক. আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জে স্টিগলার বলেছিলেন, ‘পণ্ডিতদের বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই যে, তথ্য একটা মূল্যবান সম্পদ : জ্ঞানই শক্তি। তারপরও অর্থনীতির শহরে তার বসতি বস্তিতে। অনেকটাই অবজ্ঞায়।’ বাজারে অপ্রতিসম তথ্য প্রবাহের (Asymmetric information) প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে ২০০১ সালে নোবেল জিতেছেন যে তিনজন, তারা হলেন জে স্টিগলিটজ, জি একারলফ এবং মাইকেল স্পেন্স। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি তথা আইসিটির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন বাজারে বিদ্যমান তথ্যপ্রবাহে সেই অসমতা দূর করতে সাহায্য করে বলে আজ তার এত কদর সব জায়গায়। এর ফলে শুধু উৎপাদক এবং ভোক্তার উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পায় তা নয়, সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। মোট কথা, পাঠ্যবইয়ে পড়া প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতার বাজার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণার শর্তটি বাস্তবে রূপ নেয় না অপ্রতিসম তথ্যের জন্য। জে একারলফের ‘মার্কেট ফর লেমনস’ (আমেরিকায় ত্রুটিপূর্ণ গাড়িকে ‘লেমন’ বলা হয়) বলতে চায়, ভালো কিংবা খারাপ গাড়ির তথ্য একমাত্র বিক্রেতার কাছে থাকে, যার ফলে সে খারপ গাড়িটা গছায় ক্রেতার ঘাড়ে। তবে এক্ষেত্রে আইসিটি কিছুটা হলেও আলোর সন্ধান দিতে পারে । গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে আইসিটি তথা তথ্যপ্রবাহের যে ‘বিপ্লব’ ঘটেছে তা যেন উন্নয়ন আলোচনায় গুরুত্ব পায়, সে দিকে নজর দেওয়ার উপদেশ রেখে আজকের নিবন্ধ শুরু করা যেতে পারে। তার আগে একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক
পূর্ব প্রজন্মের মানুষদের কাছে হেমন্ত কুমারের গাওয়া ‘রানার’ গানটি নিশ্চয় মনে আছে। বাংলার গ্রামের ডাক হরকরা দিন-রাত রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে। পোস্টমাস্টার টরেটক্কা টরেটক্কা করে টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছেন; তারবাহী টেলিফোনে কানফাটা চিৎকারে চারদিকে জানান দিয়ে কথা বলছেন কেউ। পাপিয়া সারওয়ারের গানটি ছিল দারুণ ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম/বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম।’ সেই আমলে টেলিফোন কিংবা টেলিগ্রাম ছাড়া খবর পৌঁছানো ছিল কঠিন। বিশেষত শহরে গুটিকয়েক সৌভাগ্যবানের ঘরে অ্যানালগ টেলিফোন ছিল, যা পেতেও ‘কানেকশন’ চালাতেও ‘কানেকশন’ লাগত দীর্ঘসূত্রতা ও দীর্ঘশ্বাসের কথা নাইবা বলা হলো। ১৯৯৭ সালে বর্তমান নিবন্ধের লেখক যখন আইসিটির ওপর এক গবেষণা চালায়, তখন ‘ভিলেজ পে ফোন’ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার আশপাশে মাত্র ১০০টি গ্রামে মোবাইল ফোন ছিল, যা বর্তমানে প্রায় প্রতি ঘরে; একটা কম্পিউটারের দাম লক্ষাধিক টাকা, এখন বিশ থেকে পঁচিশ হাজারের মতো; বর্তমানে উঁকিঝুঁকি মারছে ফাইভ জি জয়তু বাংলাদেশ। সুতরাং সেদিন গত প্রায়। রানার, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার, এনভেলপ এখন স্মৃতির অতলান্তে, ইতিহাসের পাতায়। পোস্ট অফিস এখনো বেঁচে আছে বাহাদুর শাহের বংশধরদের মতো। আজকাল চলছে তারবিহীন তেলেসমাতি চিঠি মানে এসএমএস, ইমেইল, ইন্টারনেট; টাকা আসে-যায় বিকাশে, গোপনীয় খবর হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা মেসেঞ্জারে । পৃথিবী যেমন বদলে গেছে, তেমনি গেছে বাংলাদেশ অ্যানালগ টু ডিজিটাল বাংলাদেশ। রূপান্তরের রূপকথা ব্যাখ্যায় এক অসামান্য অনুচ্ছেদ!
দুই. বেশ কিছুদিন আগের কথা। বিআইডিএস আয়োজিত এক কনফারেন্সে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক (বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান) মনজুর হোসেন। নিবন্ধের শিরোনামটি ছিল ‘আইসিটি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ডিজিটালাইজেশন কৌশল পুনর্বিবেচনা’। ডিজিটাল বাংলাদেশ দর্শনের সূত্রপাত ২০০৯ সালে উন্নয়নের পরিবর্তিত কৌশল হিসেবে এবং সেই লক্ষ্যে নীতিগত সংস্কার এবং বেশ বড়মাপের বিনিয়োগ অব্যাহত থাকল। সন্দেহ নেই যে, সময়ের বিবর্তনে আইসিটি-কেন্দ্রিক নির্দেশকে প্রভূত উন্নতি লক্ষ করা গেছে যথা মোবাইল ফোন পেনেট্রেশন, টেলি-ডেনসিটি, ইন্টারনেটের ব্যবহার, ই-গভারন্যান্স ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, অন্যান্য সূত্র থেকে ধার করে প্রাপ্ত কিছু তথ্য পেশ করা যেতে পারে : ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অনুপাত তিনগুণ বৃদ্ধি ২০১৩ সালের প্রায় ৭ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে ১৮ শতাংশ; ২০২১ সালের মে মাসে মোট ইন্টারনেট গ্রাহক ১১৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে প্রায় দশ ভাগ ব্রডব্যান্ড এবং বাকিরা ইন্টারনেট মোবাইল ব্যবহারকারী; নিবন্ধনকৃত সফটওয়্যার এবং আইটি ১৫০০; টেলিযোগাযোগ ব্যতীত আইসিটি খাতে ১০ লাখ পেশাজীবী নিয়োজিত এবং আইসিটি রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারের, প্রায় ৮০ ভাগ খানায় মোবাইল ফোন সুবিধা আছে ইত্যাদি। গত দশকের ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধির হার এবং মোবাইল ফোন পরিগ্রণের প্রকোপ বৃদ্ধি আপাতদৃষ্টে ডিজিটালাইজেশন এবং অগ্রতির সহগামিতার সাক্ষ্য বহন করে। ডিজিটালাইজেশন এবং উদ্ভাবন অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে আসছে। আইসিটি খাতের উৎপাদন সরাসরি মূল্য সংযোজিত দ্রব্য ও সেবা সৃষ্টিতে অবদান রাখে। তা ছাড়া আইসিটি উৎপাদিত দ্রব্য এবং সেবা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে খাতগুলো দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা উন্নীত করতে পারে, যা মোট অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। যেমন ২০১০ এবং পরবর্তী সময়ে তৈরি পোশাক আর রেমিট্যান্সের নিম্নগামী অবদানের মুখে আইসিটির ব্যাপক ব্যবহার একই সঙ্গে মোট উপাদান উৎপাদনশীলতা (টোটাল ফ্যাক্টর প্রোডাক্টিভিটি, টিএফপি) এবং শ্রম উৎপাদিকা (লেবার প্রোডাক্টিভিটি) বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারত। আবার, বোধগম্য নীতি সংস্কারের অনুপস্থিতে, হয়তো বিনিয়োগ এবং পুঁজির দক্ষতা বাড়িয়ে ২০১০ সময়ের বর্ধিষ্ণু প্রবৃদ্ধির ব্যাখ্যা মিলবে ডিজিটালাইজেশনে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আইসিটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রচুর অবদান রাখে, যথা- যুদ্ধোত্তর আমেরিকার প্রবৃদ্ধিতে জ্বালানি জুগিয়েছে আইসিটি এবং সেমি কন্ডাক্টর শিল্প । আইটি উৎপাদনকারী শিল্প যুদ্ধোত্তর প্রবৃদ্ধির প্রায় আট ভাগ এবং যুদ্ধোত্তর উৎপাদনশীলতায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অবদান রেখেছিল। ভারতে সফটওয়্যার সেবা রপ্তানি মোট সেবা রপ্তানির ৪৫ শতাংশ এবং মোট জিডিপির ৩.৫ শতাংশ। এমন উদাহরণ আরও আছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৩ সালের হিসাব মতে, যা মনজুর উল্লেখ করেছেন, একটা দেশে ডিজিটালাইজেশন যদি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তা হলে ওই দেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়বে ০.৭৫ শতাংশ এবং বেকারত্বের হার কমবে ১.২ শতাংশ। অন্য এক গবেষণা দেখিয়েছে যে, মোবাইল ব্যবহারকারীর আয় বৃদ্ধি ঘটে ৩-১০ শতাংশ যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং রেমিট্যান্স থেকে, মহিলাদের ক্ষমতায়নে ইতবাচক প্রভাব পড়ে এবং সংকটের সময় ভোগ মসৃণকরণে ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া ব্রডব্যান্ড পেনেট্রেশনের হার ১০ শতাংশ বাড়াতে পারলে বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পায় এক থেকে দেড় শতাংশ ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ডিজিটাল বাংলাদেশ
- আইসিটি খাত