
রাজনীতিতে দাবানলের স্মৃতি মনে রাখা জরুরি
ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে যেমন, রাজনীতিতেও তেমনিভাবে দাবানলের স্মৃতি মনে রাখা জরুরি। বিশেষত দাবানল শুরুর পটভূমি কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মনে রাখা দরকার, যে স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল উদ্ভূত হয়েছিল, তার কথা। উনসত্তরে রাজনৈতিক দাবানল শুরুর স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গ ছিল আসাদের মৃত্যুর ঘটনাটি। তার রক্তমাখা শার্ট নিয়ে প্রতিবাদমুখর বাংলাদেশ একাকার হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ড. জোহার মৃত্যু এবং আরও কিছু ছোট ছোট ঘটনা, যার সম্মিলিত রূপ এক ভয়াবহ রাজনৈতিক দাবানল সৃষ্টি করে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে আরও অনেক দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে ছোট একটি ঘটনা থেকে।
শেখ হাসিনা নানা কায়দায় বড় বড় আন্দোলন থামিয়ে দিয়ে দিব্যি বছরের পর বছর শাসন চালিয়ে গেছেন। শাপলা চত্বরে, পল্টনে সরকার পতনের সম্ভাবনাময় অনেক বিশাল জমায়েত ও আন্দোলন হয়েছে বটে। কিন্তু সেগুলো সফল হয়ে সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। সেসব আন্দোলনকে দাবানলে পরিণত করে গণ-অভ্যুত্থানের সফল ঠিকানায় নেওয়া সম্ভব হয়নি বলেই শেখ হাসিনা সুদীর্ঘ বছর একটানা ক্ষমতা দখল করে থাকতে পেরেছেন। হাসিনার ক্ষমতা যখন প্রায়-নিরঙ্কুশ ও নিশ্চিত, তখন কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ থেকে যে দাবানলের সৃষ্টি হয়, তাতেই তিনি ক্ষমতা ছাড়েন এবং দেশ ছেড়ে পালান।
ফলে রাজনীতির ময়দানে দাবানল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর স্মৃতি মনে রাখাও জরুরি। কেন মনে রাখতে হবে, তার কারণ দুটি : ১. ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসাবে; ২. ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার শিক্ষা হিসাবে। আমাদের জানা নেই, রাজনীতিকরা, বিশেষত ক্ষমতাসীনরা এসব অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা কতটুকু গ্রহণ করেন কিংবা এসব শিক্ষার গুরুত্ব আদৌ অনুভব করেন কিনা। অতীত থেকে শিক্ষা নিলে চোখের সামনে প্রতিদিন এত এত স্ফুলিঙ্গ জ্বলজ্বল করত না এবং প্রতিনিয়ত দাবানলের আতঙ্ক তৈরি হতো না এবং ঢাকা শহরে নানা কিসিমের আন্দোলন ও বিক্ষোভের ঢেউয়ের মধ্যে বন্দি হয়ে সাধারণ নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবন চালাতে হতো না।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রাজনৈতিক দাবানলের সূতিকাগার বলা যায় বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন তথা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে। প্রতিটি দাবানলের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত হয়েছিল কোনো না কোনো ক্যাম্পাসে। আন্দোলনের বীজও রোপিত হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনেই। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে তা আরও স্পষ্ট হয়। কোটা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কিছুদিন আগে থেকেই আন্দোলন করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সে আন্দোলনের দাবিদাওয়া গ্রাহ্য করার বদলে অবজ্ঞা করা হয়েছিল। এমনকি, বহু চেষ্টা করে শিক্ষকরা কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করতেও সক্ষম হননি। বরং কোনো কোনো নেতাকে নানা পদে বসিয়ে আন্দোলনকে অকার্যকর করার চেষ্টা করে তখনকার সরকার। ফলে সরকারের নেওয়া পেনশন ও উচ্চতর গ্রেডবিষয়ক সিদ্ধান্তের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কারণে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কর্মবিরতিতে ছিলেন তখন। ক্লাস বন্ধ থাকায় ছাত্ররা মনের আনন্দে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পরিস্থিতি পেয়েছিল। পুরো পরিস্থিতিই চলে গিয়েছিল সরকারের বিরুদ্ধে। বৃহত্তর মেরুকরণ হয়েছিল সরকার বনাম আন্দোলনকারীর মধ্যে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকেই সচেতন বা অচেতনভাবে সরকার নিজের বিরোধী পক্ষে ঠেলে দিয়েছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি