
শহীদ জিয়ার পানিচুক্তি বনাম শেখ হাসিনার পানিচুক্তি
গতকাল ১৬ মে ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ৪৯ বছর আগে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে লংমার্চ করেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ৯৫ বছর বয়সেও বার্ধক্যের ভার উপেক্ষা করে বিশাল মিছিল নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন মওলানা ভাসানী। কথা ছিল, রাজশাহী থেকে এ মিছিল শুরু হয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গিয়ে শেষ হবে। কিন্তু তখন সংগতভাবে মওলানা সাহেবকে পরামর্শ দেওয়া হয়, ফারাক্কা পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ নিয়ে গেলে মিছিল হয়তো ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দিতে চাইবে। সেই সুযোগ নেবে ভারত। তাই সবার পরামর্শে রাজশাহীর কানসাটে এ বিশাল লংমার্চের সমাপ্তি ঘটানো হয়।
এ লংমার্চের একটি তাৎক্ষণিক সুফল হলো, যে ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করছিল, সেই ভারতের টনক নড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়। শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি দেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা থেকে ট্রায়াল রান হিসাবে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিলেও ভারত ট্রায়াল রানের মৌখিক চুক্তি ভঙ্গ করে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে। এর প্রতিবাদ হিসাবে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানী সেই ঐতিহাসিক লংমার্চ করেন। এ লংমার্চের পর বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর এ ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। অবশেষে জাতিসংঘের প্রস্তাব মোতাবেক ভারত এবং বাংলাদেশ ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দৃঢ়তা এবং বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ মরহুম বিএম আব্বাসের বিপুল অভিজ্ঞানের কারণে এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমর্থ হয়।
১৯৯৬ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি এক চুক্তি সম্পাদন করেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন পরলোকগত জ্যোতি বসু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দেব গৌড়া। আমি এখন পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাব যে, শহীদ জিয়া ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ ভারতের কাছে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেন।
১৯৭৭ ও ১৯৯৬ সালের ফারাক্কা চুক্তিতে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত এবং তুলনামূলক পর্যালোচনা নিচে তুলে ধরা হলো-
২.
১৯৭৭ সালের ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫ বছরের মেয়াদে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের পানিপ্রাপ্তির ভিত্তি হিসাবে ফারাক্কা পয়েন্টে তিনটি সম্ভাব্য পানিপ্রাপ্তির প্রবাহকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ তিনটি সম্ভাব্য প্রবাহ হলো সর্বোচ্চ প্রবাহ, মধ্যম প্রবাহ ও সর্বনিম্ন প্রবাহ। এ তিনটি পরিস্থিতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বরাদ্দের চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুম ধরা হয় জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত। এ ৫ মাসকে সমান সমান ১৫টি স্লটে ভাগ করা হয়। ফলে প্রতি মাসে ১০ দিন করে তিনটি স্লট এবং ৫ মাসে ১৫টি স্লটে পানি বরাদ্দ করা হয়। এ বরাদ্দের ভিত্তি ছিল গঙ্গার পানি প্রবাহ। যদি প্রবাহ ৭০,০০০ কিউসেকের নিচে নেমে যায়, তখন দু’দেশ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বণ্টন নির্ধারণ করবে। এ সমস্যার একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭৭ সালের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চুক্তিতে রাখা হয় গ্যারান্টি ক্লজ। অর্থাৎ পানি প্রবাহ যাই হোক না কেন, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানির নিচে কোনো পানি দেওয়া হবে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ফারাক্কা বাঁধ
- লং মার্চ