গত আট মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যমানতা তৈরি হয়েছে ২৬টি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের রেশ না কাটতেই একে একে এদের উত্থান অনেককেই বিস্মিত করেছে, কেউ কেউ দেখেছেন সম্ভাবনার নতুন আলো, আবার কেউ কেউ দেখেছেন এটি বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতারই অনিবার্য ফল। তবে সাধারণ নাগরিকদের একটি বড় অংশের ভেতর এ নিয়ে যে একটা বিরক্তি, অনাস্থা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নতুন দলের জন্মে কখনোই অভাব দেখায়নি। তবে বর্তমানে দলগঠনের প্রবণতাটি যেন একপ্রকার ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের পর দল গঠন হতেই পারে, কারণ তা হতে পারে মতাদর্শিক সচেতনতার ফসল, অথবা কোনো অব্যক্ত অভিপ্রায়ের প্রতিবিম্ব। কিন্তু যখন একের পর এক দল আত্মপ্রকাশ করে, তা-ও কোনো সুসংগঠিত কাঠামো, আদর্শিক অবস্থান কিংবা জনসম্পৃক্ততার ছায়া না রেখেই, তখন প্রশ্ন ওঠে এদের উদ্দেশ্য কী? আর এই প্রশ্ন থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের বিরক্তি ও শঙ্কার জন্ম নেয়।
গণ-অভ্যুত্থানের মতো বৃহৎ জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, সেটি পূরণ করতে পারে সৎ ও সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেই শূন্যস্থান পূরণে নামা বেশির ভাগ দলই নেতিবাচক সমীকরণে গঠিত, যাদের নেই কোনো তৃণমূল ভিত্তি, নেই সংগঠনের স্থায়িত্ব, নেই সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন। ফলত এসব দলের উপস্থিতি রাজনৈতিক মাঠে বিভ্রান্তি ছড়ায়। মানুষ বোঝে না, কারা প্রকৃত বিরোধী, কারা রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ, আর কারা কেবল নিজেদের আত্মপ্রকাশেই সন্তুষ্ট।
সাধারণ নাগরিক এই নতুন দলগুলোর ভিড়ে দিশেহারা। রাজনৈতিক দল মানেই তো একটা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতিফলন। অথচ এখানে দেখা যায়, কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল, যারা সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের ‘বিকল্প শক্তি’ দাবি করলেও আদতে কোনো বিশেষ ধারার প্রতিনিধি নয়। তাদের বক্তব্যে নেই গভীরতা, নেই পরিণতির ভাবনা। শুধু গণমাধ্যমে উঠে আসার জন্য দল ঘোষণা করলে তা রাজনৈতিক বিন্যাসে কেবল কণ্ঠস্বরের কোলাহল বাড়ায়, সমাধানের পথ তৈরি করে না।
এতসংখ্যক দলের জন্ম রাজনৈতিক মাঠে কোনো প্রকৃত বিকল্প নয়, একধরনের ‘ছদ্ম-বিকল্প’ বাস্তবতা সৃষ্টি করে। এই ‘ছদ্ম-বিকল্প’গুলো জনগণকে বিভ্রান্ত করে এবং রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতা আরও তীব্র করে তোলে। নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে, তাদের মনোজগতে এই অকার্যকর দলগুলোর উপস্থিতি হতাশা সৃষ্টি করে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, যদি সবাই শুধু নেতৃত্বে আসার স্বপ্নে বিভোর থাকে, জনগণের কাছে কারা পৌঁছাবে?