সেটা আজ থেকে ১৪০ বছর আগের কথা। অস্ট্রিয়ার ইহুদি লেখক-সাংবাদিক নাথান ব্রিনবাম তখন স্বমুক্তি (সেলফ ইমানসিপেশন) নামে একটি সংবাদ সাময়িকী প্রকাশ শুরু করেন ভিয়েনা থেকে। ইহুদি পুনর্জাগরণ ঘটানো ও ফিলিস্তিনে তাদের পুনর্বসতি স্থাপনের ধারণাটি প্রচারণায় নিয়ে আসাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
এ কাজে ব্রিনবাম আবার অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পোলীয় ইহুদি চিকিৎসক ও লেখক লিওন পিনসকারের দ্বারা, যিনি ১৮৮২ সালে একই নামে জার্মান ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করেন। রাশিয়ায় ইহুদি নিধনযজ্ঞ দেখে ব্যথিত হয়ে ছদ্মনামে এটি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি ইহুদি সম্প্রদায়কে স্বাধীনতার ও জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করার এবং স্বাধীন ভূমিতে ফেরার আহ্বান জানান।
এর তিন বছর পর ব্রিনবামের সাময়িকী এ আহ্বানকেই আরেকটু উচ্চকিত করার জন্য মাঠে নামে। তারা তখন থেকে জায়নভূমির বিষয়টি সামনে আনতে শুরু করে। ১৮৯০ সালে ব্রিনবাম ‘জায়নিস্ট’ ও ‘জায়নিজম’ এবং ১৮৯২ সালে ‘পলিটিক্যাল জায়নিজম’ পরিভাষার প্রবর্তন করেন।
সাধারণভাবে জায়নিজম বা জায়নবাদ হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষের নিজভূমিতে ফিরে যাওয়া ও ইসরায়েলের ভূমিতে (এরেতজ ইসরায়েল) ইহুদি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (জুইশ ভার্চ্যুয়াল লাইব্রেরি)।
হাঙ্গেরিতে জন্মগ্রহণকারী লেখক-সাংবাদিক থিওডর হারজেল জায়নবাদের ধারণাটিকে নিয়ে জোরালোভাবে অগ্রসর হয়ে একে আন্দোলনে রূপ দেন এবং জায়নবাদের পিতা হিসেবে খ্যাতি পান। তিনি ১৮৯৬ সালে ‘জুইশ স্টেট’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের নিজস্ব ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ডাক দেন।
ব্রিনবাম ও হারজেল সমসাময়িক ছিলেন এবং দুজনেই জায়নাবাদী আন্দোলনের পুরোধার ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিনবাম এই পথ থেকে সরে এসে জীবনের শেষ পর্যায়ে জায়নবাদবিরোধী হয়ে ওঠেন। তবে হারজেল এই আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন, যা তাঁর মৃত্যুর (১৯০৪) ৫০ বছরের মধ্যে সাফল্যের মুখ দেখে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়—ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডেই।
একই সঙ্গে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের ওপর অনিঃশেষ বিপর্যয় নেমে আসে। সেই বিপর্যয় স্মরণে প্রতিবছর ১৫ মে পালিত হয় আল-নাকবা দিবস। ১৯৯৮ সালে ইসরায়েল যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘটা করে উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেয়, তখন ফিলিস্তিনিদের কিংবদন্তি নেতা ও ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরাও তাঁদের নাকবার ৫০ বছর পূর্তি পালন করবেন। তিনি ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনটিকে নাকবা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। সেই থেকে নাকবা পালিত হয়ে আসছে। আর জাতিসংঘ ২০২৩ সাল থেকে দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু করে।
ইসরায়েলের সংশোধনবাদী (রিভিশনিস্ট) ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইমের ভাষায়, ‘ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হলো হলোকাস্ট। আর ফিলিস্তিনি জনগণেরটা হলো নাকবা। আর এই নাকবা শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং তা হলো আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে ক্রমাগত বিতাড়ন ও অপসারণ করার নির্মম চলমান প্রক্রিয়া।’