
এবারের বাজেট হোক সাধারণ মানুষের
দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কীভাবে তাদের প্রাত্যহিক জীবন অতিবাহিত করছেন, এ খবর ক’জন রাখেন? দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষ এখন দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাড়তি অর্থ গুনতে গিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন মাইনাসে এসেছে। এ দেশ দুটিতে এখন দ্রব্যমূল্য বাড়ছে না বরং কমছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারছে না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্যমূল্যস্ফীতির তালিকায় বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে রয়েছে। টানা দশ মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামে। বিবিএসের হিসাবে ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৪৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫.৭ শতাংশ। নেপাল ও মালদ্বীপে ৭.৭ ও ৭.৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৯ শতাংশ।
বিগত সরকারের সময়ের বহুল আলোচিত চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, বরং বলা যায় আরও বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে এবং ক্রমাগত হচ্ছে তা পত্রিকার পাতা উলটালেই জানা যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখছি না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাজার তদারকি নেই বললেই চলে। যা আছে, তা বলা যায় লোক দেখানো। বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের খেয়ালখুশিমতো দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। ফলে দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিরাট বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হলেও এর বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো উপায় ছিল না। দুর্নীতি সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। জুলাই অভ্যুত্থান যার অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু যে দুর্নীতি, যে চাঁদাবাজি, যে রাজনৈতিক দখলদারত্বের কারণে জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো, তা থেকে কি আমরা সাধারণ মানুষ নিষ্কৃতি পেয়েছি? গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিদিন যা ঘটছে, যা দেখছি, তাতে করে শুধু আশাহতই হচ্ছি না, সেই সঙ্গে এ দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে বড় ধরনের আশঙ্কা জন্ম নিচ্ছে। আমরা কি ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করব না? দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহিদদের রক্তের সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আত্মদানকারীদের রক্তের সঙ্গে এভাবেই প্রতারণা করে যাব?
মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিগত দুবছরে অতি দরিদ্র হয়েছে ৩৮ লাখ মানুষ। অর্থনৈতিক বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে বেকার ২৬ লাখ ৬০ হাজার, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। এক বছরে বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূর করা না গেলে দারিদ্র্যের হার বাড়তেই থাকবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বেকার সমস্যা দূর করতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আসন্ন বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, কারণ এ খাতে স্বল্পপুঁজিতে অধিক কর্মসংস্থান সম্ভব। আসন্ন বাজেটে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি, শিল্পসহ জীবন ধারণের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশে ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আয় ও ভোগের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। দেশের সম্পদ ও আয় শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ধনীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র ও তরুণ জনগোষ্ঠী বেসরকারি খাতে চাকরি পেতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, যা তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কারণে কমে গেছে তাদের সুযোগ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাথাপিছু জিডিপি আয়ে বাংলাদেশ উন্নতি করলেও দেশটিতে সম্পদ বৈষম্য আগের তুলনায় বেড়েছে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও দুর্নীতি ব্যবসার ক্ষেত্রে এখনো বড় প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে আমরা চড়া দামে ভেজালমিশ্রিত বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্যসহ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ক্রয় করছি। বিষাক্ত কীটনাশকযুক্ত খাবার খেয়ে মরণব্যাধি ক্যানসার, কিডনি ফেইলিউর, হৃদরোগসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে, যার চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতি দ্রুত রোধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে না পারলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অস্থিরতা বাড়তে থাকবে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণসহ সহিংসতা ক্রমাগত বাড়বে বৈ কমবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এবং হতে থাকবে, যা রোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। রাজধানীতে ছিনতাই কী পরিমাণ বেড়েছে, তা প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই, বিশেষ করে গত কয়েকদিনের পত্রিকার পাতা থেকে এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। এ ধরনের পরিস্থিতি কখনই কাম্য হতে পারে না।