সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করেছে। এই দারিদ্র্য মানচিত্র কয়েক বছর পরপর প্রকাশ করে বিবিএস। কোনো কোনো বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে জরিপ করেছে। এ বছরের জরিপ অনুযায়ী দারিদ্র্য সূচকে সবচেয়ে গরিব জেলা যেমন অনেক উন্নত হিসেবে দেখানো হয়েছে, তেমনি কম গরিব জেলাগুলো বেশি গরিব হিসেবে দেখানো হয়েছে। সবশেষ প্রকাশিত এই পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তাই জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। যে জেলায় কয়েক বছর আগে ৭১ শতাংশ মানুষ গরিব ছিল, দারিদ্র্য দূরীকরণের কোনো কারণ ছাড়াই সেই জেলার মানুষ ৩১ শতাংশ গরিব কীভাবে হলো তা বলতে হবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে কুড়িগ্রাম। ২০১১ সালের দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখা যায় কুড়িগ্রামের গড় দারিদ্র্য ৬৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা হয়েছিল ৭১ শতাংশ। গরিব মানুষ বৃদ্ধির প্রধানতম কারণ ছিল নদীভাঙন। প্রতিবছর এ জেলায় যে নদীভাঙন হয়, এতে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। কোটি টাকার মালিকও হয়ে ওঠেন কপর্দকশূন্য। অট্টালিকার মালিকের ঠাঁই হয় অন্যের বাড়িতে নয়তো বাঁধের ওপর।
বর্ষা মৌসুমে এই জেলা দিয়ে প্রস্থে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার হয় নদীর প্রবাহ। তিস্তা ১০ কিলোমিটার, ব্রহ্মপুত্র ২০ কিলোমিটার, ধরলা ও দুধকুমার ৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া মাঝারি এবং ছোট মিলে প্রায় আরও অর্ধশত নদী এ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই জেলায় কয়েক শ চর আছে। যেগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। চরাঞ্চলে সব মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরের নিচেই হয়। বৈদেশিক আয় এ জেলায় তেমন নেই বললেই চলে। প্রবাসীর সংখ্যা নগণ্য। উপরন্তু ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে অন্তত ২০ হাজার গরিব মানুষ যুক্ত হয়েছে এ জেলায়। দারিদ্র্যের চিহ্ন লেগে আছে এ জেলার শহরে, গ্রামে, চরাঞ্চলে। অবকাঠোমোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় এ জেলার মানুষ গরিব।
এ জেলার জন্য কোনো সময় কোনো সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। ফলে এ জেলার কলঙ্কতিলক মুছে যায়নি। ২০২৫ সালের প্রকাশিত দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে কুড়িগ্রামের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। ৭১ শতাংশ থেকে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ৩১ শতাংশে। দেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার মধ্যেও এ জেলার নাম নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে গরিব উপজেলায়ও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বাস্তবে উন্নয়ন হয়নি। কাজির গরুর মতোই কেতাবে আছে গোয়ালে নেই।
কুড়িগ্রামসহ পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে কোনো শিল্প–কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নতুন কোনো কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি। বিদেশে নতুন করে ব্যাপক হারে যাওয়া শুরু করেনি। কৃষিপণ্যের দাম এমন হয়নি যে কৃষকেরা বিশেষ সুবিধা লাভ করেছে। কৃষিশ্রমিকদের কোনো শ্রমমূল্য বাড়েনি। বরং দ্রব্যমূল্য ক্রয়সাধ্যের চেয়ে অনেক দূরে। নদীর ভাঙনে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন-কর্মহীন হয়ে পড়ছেই। কোভিডের আক্রমণে বেড়েছে বেকারত্ব। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে কুড়িগ্রামের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। কেবল কুড়িগ্রাম নয়, দেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার একটি জেলাতেও এমন কোনো ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করেনি যে এই জেলাগুলোর দারিদ্র্যের হার কমবে। তারপরও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত নতুন দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী গরিব ১০টি জেলার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
নতুন পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুড়িগ্রামে ৭১ শতাংশ থেকে দারিদ্র্য কমে ৩১ শতাংশ হয়েছে। ৪০ শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্য দূর করার জন্য অবশ্যই এমন কার্যক্রম থাকতে হবে, যাতে ব্যাপক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। সরকার যেহেতু এ রকম কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি তাই নিশ্চিত করে বলা যায়, এই পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য নয়। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, দেশের সবচেয়ে গরিব উপজেলা ছিল কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর। সেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশ। এখন সেই উপজেলার মানুষেরও ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে পরিসংখ্যানে। পরিসংখ্যানে উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেখানে নাগরিকদের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং আগের তুলনায় এই উপজেলায় গরিব মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।