সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বরাবরই ভারতের আচরণ আক্রমণাত্মক। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) নিয়মিত বাংলাদেশের মানুষকে গুলি করে বা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সীমান্ত দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো বা ‘পুশ ইন’ করা। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ৪ থেকে ৭ মে বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা দিয়ে ভারত থেকে ১৬৭ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জনকে খাগড়াছড়ি, ৪৬ জনকে কুড়িগ্রাম, ২৩ জনকে সিলেট, ১৫ জনকে মৌলভীবাজার, ১০ জনকে চুয়াডাঙ্গায় পুশ ইন করা হয়েছে।
৯ মে শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে ফেলে রেখে যায় বিএসএফ। তাঁরা কয়েক দিন না খেয়ে থাকার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে একজনের হাত ভেঙে গেছে আর কয়েকজনের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুসারে, তাঁদের বেশ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে চোখ বেঁধে গুজরাট থেকে উড়োজাহাজ-লঞ্চে করে বাংলাদেশে আনা হয়েছে।
বিজিবির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ভারত থেকে পুশ ইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ—এই তিন দেশের নাগরিকই আছেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা ২০-২৫ বছর আগে ভারতে গিয়েছিলেন এবং পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন। সেখানে তঁারা ভারতের আধার কার্ড ও অন্যান্য ডকুমেন্ট পেয়েছিলেন। ভারতের পুলিশ বা বিএসএফ তাঁদের সেসব ডকুমেন্ট রেখে দিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন। আবার কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ভারতে নিবন্ধিত শরণার্থী এবং ইউএনএইচসিআর ভারতের পরিচয়পত্রধারী।
এক দেশের কোনো নাগরিক আরেক দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে তাঁকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন অনুসরণ করে ফেরত পাঠাতে হয়। কিন্তু ভারত যেভাবে কোনো ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এই মানুষগুলোকে বাংলাদেশে পুশ ইন করল, তা সম্পূর্ণ বেআইনি, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থী। এভাবে পুশ ইনের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে ৯ মে ভারতের কাছে কূটনৈতিক পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখনো সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে পুশ ইনের জন্য মানুষ জড়ো করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
নিকট অতীতে ভারত কর্তৃক এভাবে বড় ধরনের পুশ ইনের ঘটনা ঘটেনি। তবে এর আগে ২০০২–০৩ সালের দিকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় থাকার সময় ভারত থেকে প্রায়ই পুশ ইনের ঘটনা ঘটত। এরপর দুই দেশেই রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের পুশ ইনের ঘটনা অনেক দিন ঘটেনি। সম্প্রতি আবারও ভারত কর্তৃক পুশ ইন করা শুরু হলো। একে বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে ভারতের অনুগত সরকার পতনের পর ভারত নানাভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সে দেশের সরকারের অনুগত সংবাদমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের অনুমোদন পুনর্মূল্যায়ন বা বাতিলের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও ভারত বিনা নোটিশে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমোদন বাতিল করেছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বারবার প্রতিবাদের পরও সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা অব্যাহত আছে। সীমান্তে পুশ ইনের ঘটনাগুলো এই তৎপরতারই অংশ।
অবৈধ অনুপ্রবেশ মোকাবিলাই যদি ভারতের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে নারী–শিশুসহ এই মানুষগুলোকে চোখ বেঁধে নির্যাতন করে না খাইয়ে সীমান্তের জনমানবহীন স্থানে পুশ ইন করার প্রয়োজন পড়ত না। সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রটোকল রয়েছে। এ রকম দুটি প্রটোকল হলো জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ ও দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (সিবিএমপি), ২০১১।
এসব প্রটোকলের আওতায় আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে মানব পাচার থেকে শুরু করে সব ধরনের সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেমন সিবিএমপিতে অন্য আরও অনেক বিষয়ের মতো অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মানব পাচারের মতো সমস্যার মীমাংসার জন্য ভারতীয় বিএসএফ এবং বাংলাদেশের বিজিবির পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (নোডাল অফিসার) সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। তাঁদের কাজ হলো সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো বিরোধ তৈরি হলে তা আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা। স্পষ্টতই একতরফাভাবে গণহারে মানুষদের বাংলাদেশে পুশ ইন করা সিবিএমপি প্রটোকলের লঙ্ঘন।