
অনেক উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু এ উৎপাদন বাড়াতে আমাদের কী কী ক্ষতি হয়েছে তার মূল্যায়ন করতে হবে
কৃষি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ আমাদের দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কৃষি ও কৃষককে নিয়ে বণিক বার্তার যে ধারাবাহিক প্রয়াস তা সত্যি প্রশংসনীয়। আমাদের গণমাধ্যমে বন্যা, খরা, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের বিপর্যস্ত অবস্থা, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কিংবা কৃষিভিত্তিক যে গবেষণা সেগুলো যথাযথ গুরুত্ব পায় না। অথচ আশির দশক পর্যন্ত দেশসেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রেই কৃষি কাঠামো, কৃষকের বিভিন্ন সমস্যাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হতো। এরপর তা কমে যায়। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় সামনে আনা দরকার।
আমি দুটি বিশেষ খবরের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমটি হলো, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ১৩ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন আলুর দাম, পেঁয়াজের দাম ইত্যাদি চাপের কারণে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন সরাসরি জমিতে। আরেকটা খবর হচ্ছে, ক্যান্সার হাসপাতালের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে রোগীদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ হচ্ছেন কৃষক। কেন কৃষকরাই বেশির ভাগ ক্যান্সার রোগীতে পরিণত হচ্ছে তা গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। আমাদের কাণ্ডজ্ঞান ও গবেষকরাও একমত হবেন যে কৃষি উৎপাদনে এখন যে ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে তাতেই কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একদিকে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। পাশাপাশি সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে যে আমরা প্রতিদিন খাবার হিসেবে যা খাচ্ছি তাতে বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যালের উপাদান পাওয়া যাচ্ছে। আমরা বারবার নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আলোচনা করলেও আমাদের খাদ্য তালিকায় যা আছে তা মোটেও নিরাপদ নয়; আমরা মূলত বিষ খাচ্ছি। আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন যে খাদ্য বিষাক্ত হওয়ার সঙ্গে জিডিপি বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। কেননা অনেক বেশি পরিমাণে কৃষিজাত পণ্য যেমন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন, গরু মোটাজাতকরণ প্রভৃতি উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা বাছ-বিচারহীনভাবে রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করছি। ফলে উৎপাদন বেড়ে জিডিপি বাড়লেও খাবার হয়ে যাচ্ছে বিষ। আবার এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিলেও জিডিপি বাড়ে। তাই আমাদের সব সরকারই যখন জিডিপি বাড়ার ফলে দেশ উন্নত হয়ে যাচ্ছে বলে যে ঢাকঢোল পেটায় সেই উন্নয়নে মানুষের জীবনমানের কোনো অগ্রগতি হয় না। বরং উন্নয়ন যে মানুষের জীবন, জীবিকা ও অস্তিত্ব খর্ব করেও হতে পারে সে দৃষ্টান্ত কিন্তু বারবার সামনে আসছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কৃষি, কৃষক, খাদ্যনিরাপত্তার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কীভাবে এগিয়ে যেতে পারি তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা দরকার।
বাংলাদেশের সামর্থ্যের আলোকে কৃষি, কৃষক, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় করে কখনই কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিটি দেশের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা আলাদা। তেমনি বাংলাদেশের শক্তির জায়গাটা হচ্ছে মাটির উর্বরতা যেখানে বীজ পড়লেই সোনা হয়ে ফুটে। সেই উর্বর ভূমি যদি রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করে নষ্ট করে ফেলি তাহলে আমাদের পরবর্তী জেনারেশন কোথায় চাষবাস করবে? এখানে ইলোন মাস্ক থাকলে হয়তো বলতেন, মঙ্গল গ্রহে চাষ করা হবে! বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা তো আর সম্ভব নয়। তাই আমাদেরকে মাটিতেই চাষ করতে হবে। আমাদের আর একটা শক্তির জায়গা হচ্ছে পানি। মাটির ওপর পানি, মাটির নিচে পানি; এ পানিসম্পদ আমাদের ঐশ্বর্য যা পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটা দেশের আছে। তাই আমাদের এ বিশাল পানিসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর এ দুই শক্তি নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে কাজ করছে যারা—মানুষ, তারাও বাংলাদেশের অন্যতম শক্তি। আর সীমাবদ্ধতার জায়গা হচ্ছে আমাদের মানুষ বেশি, জমি কম। তাই এ তিন শক্তির সমন্বয়ে সীমাবদ্ধতাকে দূর করে কৃষি, কৃষক ও খাদ্যনিরাপত্তার উন্নয়নে কোনো সম্মিলিত প্রয়াস কখনো নেয়া হয়নি।
পাকিস্তান আমলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে কয়েক ভলিউম গবেষণাপত্র প্রকাশ করে এবং সবুজ বিপ্লব ঘোষণা করে। মূলত সবুজ বিপ্লব ছিল একটি প্যাকেজ যার মধ্যে ছিল উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও যান্ত্রিক সেচ ব্যবস্থা। কিন্তু এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের পরবর্তী সময়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে বা এখনো পড়ছে তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। এটাও সত্য যে আমাদের দেশে আরঅ্যান্ডডি (রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট) অনেক কম। তাই নিজেদের স্বার্থে স্ব-উদ্যোগে কখনই কোনো গবেষণা হয় না। হ্যাঁ, যদি বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেয় তাহলে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। এ গবেষণা না হওয়ার ফলে সবুজ বিপ্লবের ফলাফল কী তা জানতে পারিনি। বণিক বার্তার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান যদি উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে ভবিষ্যতে এ বিপ্লবের কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস আমরা জানতে পারব।
এটা সত্যি আমাদের অনেক উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু এ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে আমাদের কী কী ক্ষতি হয়েছে তার মূল্যায়ন করতে হবে একটি কল্যাণকর ভবিষ্যতের জন্য। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আমরা স্বাধীন হলেও পাকিস্তান মডেল থেকে বের হতে পারিনি। সেই সেচ ব্যবস্থা, বন্যা নিয়ন্ত্রণে মাটি ও পানিসম্পদের ওপর চাপ পড়ে। এর ফলে এখানকার মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কৃষকের ভোগান্তি
- কৃষি উৎপাদন