প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, 'একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এবার আর দিনের ভোট রাতে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।'
গত ৫ মে সকালে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন মিলনায়তনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ময়মনসিংহ অঞ্চলের নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সিইসি বলেন, 'আমি চাই না কোনো অপবাদ নিয়ে বিদায় নিতে। তাই যতদিন দায়িত্বে আছি, ততদিন সঠিক নিয়তে আইন মেনে ও বিবেকের সায় নিয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাব।' (ডেইলি স্টার অনলাইন, ৫ মে ২০২৫)।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সিইসি এবং তার সহকর্মীদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে যে, তারা সত্যিই জাতিকে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চান। ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অতীতের কমিশনগুলো যেভাবে বিতর্কিত হয়েছে, তারা সেই পথে হাঁটতে চান না।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ২৪ নভেম্বর সিইসি হিসেবে শপথ গ্রহণের পরে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, 'আমাদের নিয়ত সহিহ। আমরা জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চাই। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে যা করা দরকার, তাই করব।' তবে তিনি এও বলেন যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জনগণের সহযোগিতা লাগবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে।
যদিও সিইসি তথা তার পুরো কমিশন চাইলেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয় কি না—সেটি বিরাট তর্ক। কেননা, নির্বাচনটি কেমন হবে সেটি মূলত নির্ভর করে ক্ষমতায় থাকা সরকার বা দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও ইচ্ছার ওপর।
যেহেতু বিদ্যমান ব্যবস্থায় পুরো মাঠ প্রশাসন সরকারের নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ, ফলে সরকারের মেশিনারিজ, বিশেষ করে তার আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর ওপর সরকারের নির্দেশনা কেমন থাকে—তার ওপর নির্ভর করে ভোট কেমন হবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের 'সহিহ নিয়ত' দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কঠিন। আর এই কারণেই এসেছে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশে যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয় না বা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো তা মেনে নেয় না—ফলে জাতীয় নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই বিশ্বাস থেকেই ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। যদিও যে আওয়ামী লীগ এই বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল, তারাই ১৫ বছরের মাথায় ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিধানটি বাতিল করে দেয় এবং যার মধ্য দিয়ে পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থায় সরকার তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে এবং একই প্রক্রিয়ায় চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করলেও সেটি সম্ভব হয়নি। বরং অভ্যুত্থানের মুখে তাদের পতন হয়।
এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, যদি আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাতিল করা না হতো, তাহলে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনে দেশের প্রধান দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ঘুরেফিরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতো। দেশে একটা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ক্ষমতার ভারসাম্য বিরাজ করতো। সেটি অন্য প্রসঙ্গ। আসা যাক সিইসির রাতের ভোটের প্রসঙ্গে।
কেন তিনি বললেন যে এবার দিনের ভোট দিনেই হবে? 'রাতের ভোট' কথাটি চালু হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। অভিযোগ আছে, ওই নির্বাচনের আগের রাতেই অসংখ্য ব্যালট পেপারে নৌকা মার্কায় সিল দেওয়া হয়েছিল। ভোট গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্তরাই কাজগুলো করেছিলেন। ফলে পরদিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অনেকেই জানতে পারেন যে তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। এরপর থেকে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে 'রাতের ভোট' বলে অভিহিত করা হয়।