
বিএনপিকে চাপে রাখতেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ?
আওয়ামী লীগের রাজনীতি যে নিষিদ্ধ করা হবে—সেটি গত ৮ অগাস্টের পরে ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। কেননা, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং এরপরে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তরফে অব্যাহতভাবে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানানো হচ্ছিল। যে দাবিতে গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) রাত ১০টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান করে এনসিপি। তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানায় আরও কিছু দল ও সংগঠন। শুক্রবার জুমার নামাজের পরে তারা মিন্টো রোডের মুখে ট্রাকের ওপরে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে গণজমায়েত করে। এরপর এই জায়গা ছেড়ে দিয়ে অদূরে শাহবাগে গিয়ে অবরোধ (ব্লকেড) করে। সবশেষ শনিবার সন্ধ্যার পরে তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে সরকারকে এক ঘণ্টা সময় দেয়।
শনিবার রাত ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসাথে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। পাশাপাশি, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে।
বস্তুত, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিটি গত ৯ মাস ধরে জারি থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কথায় মনে হয়েছে, তিনি বা তার সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে নন। গত ২০ মার্চ ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিচার করা হবে।
এর আগে মার্চের শুরুতে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তারা নেবে। অবশ্য তিনি এ–ও বলেন, নির্বাচনে কে অংশ নেবে, তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে।
গত ২ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার একা সিদ্ধান্ত নেবে না। রাজনীতিক দল ও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
যদিও দেখা গেল যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার মূলত জাতীয় নাগরিক পার্টির চাপ ও আলটিমেটামের মুখে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দিলো। প্রশ্ন হলো, কোনো এক বা একাধিক দল সরকারের ওপর যেকোনো বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করলেই সরকার সেই দাবি মেনে নেবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেখানে সরাসরি বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা তার সরকারের নেই; সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টাও যেখানে বললেন যে তারা এ বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন না— সেখানে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হলো কী করে? তাহলে কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যে দলগুলো বৃহস্পতিবার রাত থেকে রাজপথে ছিল, তাদের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টরা ব্যক্তিগতভাবে বা অফিসিয়ালি যোগাযোগ করে তাদের মতামত নিয়েছেন, নাকি সরকার অন্যদের মতামত নেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেননি? নাকি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রক্রিয়াটি ভেতরে ভেতরে চলছিল—যেটিকে বৈধতা দেয়ার জন্য এমন একটি পরিস্থিতি তৈরির প্রয়োজন ছিল, যাতে সরকার বলতে পারে যে, তারা এককভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়নি, বরং রাজনৈতিক চাপেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে?