
গৌতম বুদ্ধের দর্শন : গণতন্ত্র ও যুক্তিবাদ
ইতিহাসবিষয়ক গবেষকদের মতে, গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ সালে। তার পিতার নাম শুদ্ধোদন এবং মাতার নাম মায়াদেবী। পিতা শুদ্ধোদন ছিলেন শাক্যদের রাজা। উল্লেখ্য, তখনকার রাজ্যগুলো ছিল প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের আগে অন্তত দুই শতাব্দী ছিল চার্বাক দর্শনের (লোকায়ত) প্রভাব। চার্বাক দর্শন ছিল বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী। ইহজাগতিকতা ছিল চার্বাক দর্শনের মূল ভিত্তি। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বৌদ্ধ দর্শনের পশ্চাৎভূমি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যদিও বা লোকায়ত দর্শনের প্রভাব ছিল; কিন্তু সমকালীন সমাজব্যবস্থার মধ্যে অদৃষ্টবাদ ও ভক্তিবাদের প্রাধান্য ছিল ব্যাপক এবং সমাজ ছিল স্থবির। তখন বর্ণবাদ, জাতিভেদ, যাগযজ্ঞ ও দেবতার নামে পশুবলি-ধর্মের নামাবলি পরিয়ে সমগ্র সমাজব্যবস্থাকে নানা প্রথার শৃঙ্খলে বন্দি করে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্য পুরোহিতরা। প্রাচীন ভারতীয় স্থবির সমাজে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব একটি বিপ্লবী ঘটনা, এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বৌদ্ধ দর্শন বুদ্ধের চার নীতির মধ্যে নিহিত-১. অদৃশ্য শক্তিকে (নিরীশ্বরবাদী) অস্বীকার করা; অন্যথায় ‘মানুষ স্বয়ং নিজের প্রভু’-এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়, ২. আত্মাকে স্বীকার না করা, ৩. কোনো গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে স্বীকার না করা, ৪. জীবনপ্রবাহকে এ শরীরের মধ্যেই সীমিত মনে করা।
অদৃশ্য শক্তিকে (ঈশ্বর) স্বীকার করে নিলে মানুষ তার অধীন, মেনে নিতে হয়। বুদ্ধ মনে করেন, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। তিনি মনে করেন, বিশ্ব বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা মানুষেরই চেষ্টার ফসল এবং বিশ্বের ভবিষ্যৎও মানুষের হাতে। বুদ্ধের মতে, মানুষের নিজস্ব কর্মের স্বাধীনতার মধ্যে ধর্ম সার্থক হতে পারে।
বৌদ্ধ দর্শন হলো নিরীশ্বরবাদী অর্থাৎ পরমাত্মায় বিশ্বাসী নয়। মূলগতভাবে নিরীশ্বরবাদ বলতে বোঝায় সেই মতবাদ-যা আত্মা বা পরমাত্মার অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না। মানবতাবাদ ও আত্মা বা পরমাত্মার অস্তিত্বকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিধানকে মান্য করে না। নিরীশ্বরবাদে যুক্তিহীন আধ্যাত্মবাদী চিন্তাকে বাতিল করে। মানবতাবাদীর মধ্যে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি রয়েছে। সে যুক্তির পথ ধরে সবকিছুকে বিচার করে, তার মধ্যে থাকে সুন্দর সমাজ বিকাশের প্রেরণা, মানুষকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রেরণা। ‘নিরীশ্বরবাদ’ মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ হয়ে ওঠে।
বুদ্ধ দর্শনের একটি ভিত্তিপ্রস্তর হলো ‘অনাত্ম’ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুসারে মানুষের দেহের মধ্যে স্বতন্ত্র ও অপরিবর্তনীয় কোনো সত্তা নেই, যাকে সে ‘আমি’ বলে ভাবতে পারে। মানুষ মোহের বশে এ রকম একটি আমিত্বে বিশ্বাস করে এবং এ মোহই তার দুঃখের কারণ। বুদ্ধ মানুষকে পাঁচটি অংশে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেন : রূপ (form), বেদনা (feeling), সংজ্ঞা (perception), সংস্কার (volitional action) ও বিজ্ঞান (consciousness)। এগুলোকে একেকটি স্কন্ধ বলা হয়। এ পঞ্চ মিলেই মানুষ। রূপ হলো মানুষের জড় দেহ, বেদনা হলো সব রকম অনুভূতি, সংজ্ঞা হলো কোনো বিষয়কে শনাক্ত করা, সংস্কার হলো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্ম এবং বিজ্ঞান হলো চেতনা। সুতরাং পঞ্চ স্কন্ধের কোনটি আত্মা নয়। বুদ্ধ দর্শন মতে, মানুষ যেহেতু পঞ্চ স্কন্ধের সমষ্টি, তাই মানুষের মধ্যে আত্মা বলে কিছুই নেই। যে দর্শনে অনাত্মাকে কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে, সেই ধর্মীয় দর্শনে পুনর্জন্মের কোনো স্থান নেই। বুদ্ধ কোথাও পুনর্জন্মের কথা বলেননি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বুদ্ধ পূর্ণিমা