
মিত্রতা মানে শুধু অস্ত্র কেনা নয়, আত্মা বেচাও
ভূ-রাজনীতি এখন আর কূটনৈতিক বৈঠকে করমর্দন, জাতিসংঘে গলাবাজি, কিংবা চায়ের কাপ হাতে ঝকঝকে ছবির শুটিংয়ের নাম নয়। আজকের ভূ-রাজনীতি একেবারে ‘হাই ডেফিনিশন হরর থ্রিলার’—যেখানে প্রতিটি চুক্তিপত্র মানে শুধু উন্নয়ন নয়, আত্মার একটি করে কিস্তি বন্ধক রাখা। মিত্রতা মানে এখন আর বন্ধুত্ব নয়, বরং এক লম্বা ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান—যেখানে কবে, কীভাবে তোমার আত্মার শেষ কিস্তিটুকু তুলবে তারা, সেই হিসাব আগেই অ্যালগরিদমে সেট করা।
আগে দুই দেশ বন্ধুত্ব করত সিনেমা বানিয়ে, সাংস্কৃতিক উৎসবে নাচগান করে, ক্রিকেট সিরিজ দিয়ে, আর রাষ্ট্রপ্রধানেরা একে অপরকে ‘বড় ভাই’, ‘ছোট ভাই’, বা ‘মিলেমিশে থাকার প্রতীক’ বলে সম্বোধন করতেন। এখন বন্ধুত্ব মানে—তোমার দেশে আমার সামরিক ঘাঁটি, তোমার বাজারে আমার ডিফেন্স কনট্রাক্ট, আর তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্কলারশিপ প্রোগ্রামে মগজধোলাইয়ের ব্যবস্থা।
আমেরিকা বলে: ‘তুমি যদি আমাদের বন্ধু হও, তাহলে আমরা এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান দেব—শুধু যুদ্ধ নয়, সঙ্গে থাকবে মানবাধিকার মূল্যায়ন, গণতন্ত্রের এক্সেল শিট, আর মাঝে মাঝে কিছু নিষেধাজ্ঞা—তোমার আচরণ যদি আমাদের স্ট্যান্ডার্ডে না পড়ে।’
চীন বলে: ‘তুমি আমাদের বেল্ট অ্যান্ড রোডে ঢোকো। আমরা রেললাইন দেব, বন্দর বানাব, পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাব। শুধু ছোট্ট একটা কথা—ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা তোমার হলেও চাবিটা থাকবে আমাদের হাতে।’
রাশিয়া বলে: ‘তেল নাও, ভালো দামে। মাথায় তেলও দেব, মনেও শান্তি আসবে। তবে যদি বেশি পশ্চিমে তাকাও, তাহলে হঠাৎ একদিন দেখবে—তোমার দেশে “নতুন রাজনৈতিক বিকল্প” ভাইরাল হয়ে গেছে, যাদের নাম আগে কোনো মিছিলে শোননি—কিন্তু এখন তারা “জনগণের চাওয়া”।’
এটাই আজকের ভূ-রাজনীতির বাস্তবতা—এক ভয়াবহ অথচ দারুণ অভিনয়পূর্ণ সার্কাস, যেখানে রাষ্ট্ররা কূটনীতিক মুখোশ পরে লড়াই করে, নীতির নামে নাটক চলে, আর বন্ধুত্ব মানে হয় ‘আমার সঙ্গে থেকো না হলে তোমার বিদ্যুৎ থাকবে না।’
এ যেন নেটফ্লিক্সের ‘জিওপলিটিকস আনলিমিটেড’—এক ধারাবাহিক সিরিজ, যেখানে প্রতিটি দেশ একেকটা পর্ব। কেউ থ্রিলার, কেউ ট্র্যাজেডি, কেউবা নিছক কমেডি। আর আমরা? দর্শক—যখন-তখন প্লট টুইস্টে জড়িয়ে পড়া চরিত্র। অথচ স্ক্রিপ্ট আমাদের হাতে নেই।
একসময় জোট মানে ছিল আদর্শের মিল—ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, মুক্তবাজার, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এখন জোট মানে—কে কাকে এনএসএর স্নিফার গিফট করেছে, কার দেশে কয়টা ডেটা সেন্টার খুলেছে, আর কে কার সার্ভেইলেন্স কনট্রাক্টে সাইন করেছে।
একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি একজন উন্নয়নশীল দেশের সরকারপ্রধান। হঠাৎ একদিন দাওয়াত আসে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’-এ। গায়ে চাপান ঢাকাই জামদানি, হাতে নেন শান্তির প্রতীক। গিয়ে আবিষ্কার করেন—‘শান্তি’ মানে: ‘তুমি যদি আমাদের মিত্র হও, তাহলে তোমার দেশে একটা সেনাক্যাম্প খুলব, আর তোমার রাডার সিস্টেমে নতুন সফটওয়্যার ইনস্টল করব—যেটা চলে আমাদের সার্ভারে।’
আপনি প্রশ্ন করেন, ‘এই সফটওয়্যারে কী কী ফিচার আছে?’ উত্তর আসে, ‘ওটা ক্লাসিফায়েড। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন—আপনার নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব, সার্ভেইলেন্স চালিয়ে।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- যুদ্ধ ও সংঘাত
- ভূরাজনীতি