ছোট ব্রয়লার মুরগির খামারিদের ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’
বাণিজ্যিক ব্রয়লার ফার্মিংয়ে ‘হিট’ স্ট্রেস বিশ্বব্যাপী একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই হিট স্ট্রেসের ফলে সরাসরি মুরগির শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে সামার হিট ওয়েভ পোলট্রিশিল্পের জন্য এক নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে যখন মুরগির বডি ওয়েট এক কেজির ওপরে থাকে। হিট স্ট্রেসের ফলে মুরগির স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ, পানি গ্রহণ ও পুষ্টি বিপাক কমে যায়। ফলে মাংসের পরিমাণও কমে যায়।
অন্যদিকে এই সময় ফার্মের লিটার সারাক্ষণ ভেজা থাকে। অ্যামোনিয়া–সৃষ্ট দুর্গন্ধের কারণে আশপাশের পরিবেশ অসহনীয় হয়ে পড়ে। তবে সামার হিট ওয়েভের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো মুরগির ঘন ঘন হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া এবং মারা যাওয়া। এর ফলে খামারি সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বাতাসে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হলে সেটিকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। তাপমাত্রা যদি ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে তাহলে সেটিকে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে সেটিকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে। আর তাপমাত্রা যদি ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যায়, সেটিকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।
আমাদের দেশের সঙ্গে ভারতের প্রায় ২৪৬ কিলোমিটার স্থল সংযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশ রাজ্যগুলোর সঙ্গে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যেমন চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রংপুর জেলাগুলো সংযুক্ত। ভারতের ওই এলাকাগুলোতে এপ্রিল মাস থেকে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠানামা করে। তাই ওই সব এলাকার উত্তপ্ত বায়ু প্রথমে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে উত্তপ্ত করে এবং পরে বেশির ভাগ জেলায় তা ছড়িয়ে পড়ে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়ায় ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে ২০২৩ সালে একটানা ২৩ দিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। গরমকালে বাতাসে তাপমাত্রা (৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও জলীয় বাষ্পের পরিমাণ (৮৫ শতাংশ) অধিক থাকায় ফিলিং টেম্পারেচার অনেক বেশি অনুভূত হয়। দ্রুত বর্ধনশীল ব্রয়লার মুরগির সহনীয় বাতাসের তাপমাত্রা হলো ২৫-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা (৫৫-৬০ শতাংশ)।
যদি এই হিট ইনডেস্কে কোনো তারতম্য হয়, তা অবশ্যই মুরগির বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গবেষণায় দেখা গেছে, হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মুরগি ‘একিউট হিট স্ট্রেসে’ (বহমান তাপমাত্রা যদি ১-৫ দিন থাকে) আক্রান্ত হয়। এর ফলে বাজারে বিক্রির বয়সী মুরগির মৃত্যুর কারণে খামারির ব্যাপক ক্ষতি হয়। একিউট হিট স্ট্রেস সাধারণত মুরগির বৃদ্ধি কম হওয়াতে কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই। অন্যদিকে যদি হিট ওয়েভ ৫ দিনের বেশি চলমান থাকে তাকে ক্রনিক হিট স্ট্রেস বলে। আর তেমন হলে মুরগির সামগ্রিক বৃদ্ধিতে ব্যাপক ধস নামায়।
অন্য আরেক ধরনের হিট স্ট্রেস আছে, যা চক্রাকারের। যেমন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অত্যধিক গরম থাকার পর আস্তে আস্তে তাপ কমতে থাকা। এই ধরনের হিট স্ট্রেস সাধারণত আমাদের দেশে সাধারণ। তা একিউট বা ক্রনিকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ব্রয়লার মুরগি যদি ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৫৫ শতাংশ আর্দ্রতায় একটানা ১৪ দিন পালন করা হয় তবে প্রতিটি মুরগি প্রায় ৫০ শতাংশ খাবার কম খায় ফলে তাদের ৬৬ শতাংশ ওজন বৃদ্ধি কমে যায়।
অন্যদিকে স্বাভাবিক অবস্থায় একটি মুরগি তার মোট গ্রহণ করা খাদ্যের প্রায় ২ দশমিক ৫ গুণ পানি খায়। বাইরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় ড্রিংকারের পানি খুব দ্রুত গরম হয়ে যায়। ফলে গরমে ব্রয়লার পানি কম খায়। মুরগি কম পানি পান করায় তার খাদ্যনালিতে ক্ষত হয়। এমনকি অহজমযোগ্য খাদ্য পায়ুপথ দিয়ে সরাসরি বের হয়ে লিটারে যুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ওই সব লিটার নষ্ট হয়ে বিশেষ করে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস বায়ুর চেয়ে হালকা হওয়ায় দ্রুত ওপরে উঠে যায় এবং আশপাশে গন্ধ ছড়ায়। মোটাদাগে অত্যধিক গরম ব্রয়লারের খাদ্য ও পানি গ্রহণ কমিয়ে দেয়, ফলে খাদ্য বা পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হিট স্ট্রেস কমানো সম্ভব নয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাণিজ্যিক খামার
- ব্রয়লার মুরগি