
সাত রাজ্য দখলের আনন্দ, বাস্তবতা কঠিন
ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ বাধাতে পারে। যুদ্ধ যদি লেগেই যায়, আমি ভাবছিলাম আমরা কাকে সমর্থন করব? ভারতকে সমর্থন করার প্রশ্নই আসে না, কারণ ভারত ইদানিং আমাদের সঙ্গে যেভাবে বৈরিতা শুরু করেছে, তা খুব দুঃখজনক।
পাকিস্তানকে সমর্থন করা কি ঠিক হবে? আমার মনে পড়ে, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটা বড় যুদ্ধ হয়েছিল, তা-ও এই কাশ্মীর নিয়ে। আমি পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলাম, তখন আমরা এক দেশ ছিলাম। আমি সেই সময় ঢাকা কলেজ পড়ি, কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার এক মাসের স্কলারশিপের বেশ বড় একটা অংশ কেটে নিয়ে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা তহবিলে চাঁদা দিয়েছিল। আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে আমি হয়তো সমর্থন দিতে পারব, চাঁদা অবশ্যই দেব না, কারণ আমি যুদ্ধবিগ্রহ একদম পছন্দ করি না।
কিন্তু বাংলাদেশ কি পাকিস্তানকে সমর্থন করবে? অবশ্য সেটাও সম্ভবত শুধু নৈতিক সমর্থন হবে। কারণ আমাদের এমন কোনো সম্পদ নেই কিংবা যুদ্ধ সরঞ্জামও নেই যে, যা পাঠিয়ে আমরা পাকিস্তানকে কোনো অর্থবহ সাহায্য করতে পারি। তাই বলে কি বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবে না?
এইসব ভাবতে ভাবতে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। একটা খবর দেখে দারুণ উৎসাহী হয়ে পড়লাম। কে বলে বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবে না? আমাদের একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল পথ দেখালেন। তিনি তার ফেইসবুকে লিখেছেন এবং পত্রিকাওয়ালারা তার উধ্বৃতি দিয়েছে, “ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে বাংলাদেশের উচিত হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য দখল করে নেওয়া। এ ব্যাপারে চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করি।”
একজন জেনারেলের কথা, ফেলনা নয়। তিনি শুধু একজন জেনারেলই নন, খুবই দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন– ‘পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ’ বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ প্রধান এই ভদ্রলোক।
শুরুতেই বলে রাখা ভালো তিনি কিন্তু স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান। নাম এএলএম ফজলুর রহমান। কাজেই তাকে সরকারের অধীনস্থ কেউ ভাববার অবকাশ নেই।
যাই হোক, আমরা যারা ভাবছিলাম বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবে না, আমাদের ধারণা সম্ভবত খুবই ভুল। অবশ্য আমরা যারা সাধারণ মানুষ, দেশের সামরিক অস্ত্রভাণ্ডার বা আমাদের তিন বাহিনীর শক্তি সামর্থ্য সম্বন্ধে তাদের ধারণাই বা কতটুকু! তাদের এইসব জানার কথাও নয়।
অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আমাদের এইসব অতি উৎসাহে কিছুটা রাশ টানলেন। তিনি বলেছেন, বিডিআর কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) এএলএম ফজলুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কোনোভাবেই একমত পোষণ করে না অন্তর্বর্তী সরকার– “মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের ব্যক্তিগত মতামতকে সরকারের মতামত হিসেবে বিবেচনা না করার জন্য আমরা সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) এএলএম ফজলুর রহমানের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়েছে।
আমাদের সরকারের সতর্কতার বিষয়টা নিশ্চয় বোধগম্য, তারা আর উত্তাপ বাড়াতে চান না বলে আরও অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি। এটা অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত– ওদের দুদেশের যুদ্ধ, আমাদের কি দরকার ওই সবে জড়িয়ে? তবু আমার যে জিনিসটা ভালো লেগেছে, একজন মেজর জেনারেলের মুখে আমাদের সামরিক বাহিনীর শক্তি সামর্থ্যের কথা জানলাম, তার মতে আমরা প্রস্তুত ভারতীয় সাতটা রাজ্য দখল করে নিতে। কোন বাংলাদেশিরই-বা ভালো না লাগবে শুনতে? বলে রাখা দরকার, ব্যক্তিগতভাবে আমি এই রকম দখলদারিত্ব অপছন্দ করি।
সরকারের বিজ্ঞপ্তি পড়ার পর ভাবছিলাম এনিয়ে আর ভাবব না। কিন্তু একে ভিত্তি করে আরও কত ভাবনা মনে জড়ো হতে শুরু করল! আচ্ছা বাংলাদেশ যদি সাতটা রাজ্য দখল করতে পারে, তবে পাকিস্তানের খানেরা কেন ভারতের একটা মাত্র রাজ্য, কাশ্মীর দখল করে নিতে পারছে না? কি জানি, হয়তো তাদের বাংলাদেশের মতো এত সামরিক সাজ-সরঞ্জাম নেই তাদের! কিন্তু আণবিক বোমা তো আছে।
আর পাকিস্তানিরা দখল করলেই কি কাশ্মীর স্বাধীন হয়ে যাবে? আজাদ কাশ্মীরের কথাই ধরুন, কতটুকুই বা আজাদ? একেকবার পাকিস্তানে একেক সামরিক প্রধান আসেন দেশ শাসন করতে, সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরের সরকারও বদলে যায়। বেচারা কাশ্মীরী জনগণ– একদিকে যখন নরেন্দ্র মোদীর বাড়তি হিন্দু ভোটের প্রয়োজন পড়ে, তার প্রধান অস্ত্র কাশ্মীর এবং শুধু কাশ্মীর নয়, আশপাশের অন্য অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর খড়গহস্ত হন তিনি; অন্যদিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে যখন সামরিক সরকারের ক্ষমতা একটু দুর্বল হয়, তখনই তাদের শুরু হয় ‘কাশ্মীর কার্ড’। এই দুই যাঁতাকলে দুর্বিষহ কাশ্মীরিদের জীবন।