
আমাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রয়োজন
আমাদের ছোট দেশ, তাই এর আবার ভূরাজনৈতিক অবস্থান কী-এরকম একটি ধারণা বিদ্বৎসমাজে চালু আছে। ফলে সেই শিক্ষিত, প্রগতিশীল মনে ও মননে কখনোই একথা জাগেনি যে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বলতে তারা মনে করেন, প্রতিবেশী ভারতের মতো একটি দেশের সঙ্গে আমাদের পেরে ওঠা সম্ভব নয়। এ মানসিকতাই মূলত আমাদের হীনবল করে রেখেছে বলে আমার মনে হয়। আমরা সামরিক শক্তিতে দুর্বল বলে কোনো বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিজেদের জনগণ ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে পারব না। এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের প্রধান শত্রু।
১.০
আমাদের মন ও মানসিকতাকে শাসন করছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও তাদের চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক আধিপত্য। আমরা চিন্তাক্ষেত্রে যেমন পরাধীন, তেমনি সেই পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও প্রায় নেই বললেই হয়। কিন্তু তারপরও সমাজের কিছু মানুষ তো নতুন কিছু চিন্তা করে। দেশের কৌশলগত সম্পর্ক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে চিন্তা করে। কী করে দেশের সম্পদ নিরাপদ ও রক্ষা করা যায়, কী করে দেশের সম্পদ জনগণের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলে দেওয়া যায়, সেই চিন্তাও তো করে। এই শ্রেণির মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা দেখতে পাই মহাসমুদ্রের মধ্যে ভাসমান শৈলখণ্ডের শিখর হিসাবে। তলে যে বিপুল অংশ, যাদেরকে জনগণের সঙ্গে চিহ্নিত করলে তা শ্রেয়তরই হবে।
১.১
আমরা চিন্তাশীল জাতি নই। আমাদের প্রধান শক্তি রাজনৈতিক আবেগ। আমাদের প্রধান শত্রুও রাজনৈতিক আবেগ। এ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবেগের ঘাড়ে চেপে আমরা চলেছি ৭৭ বছর (পাকিস্তানি ২৩ বছরসহ) ধরে। এ আবেগেরই প্রাধান্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একটি সংহত অবস্থানে পৌঁছাতে দেয়নি। গত ৫৪ বছরে স্বাধীনতার সূর্য উদিত থাকলেও সেই সার্বিক বিষয়টিকে আমরা কেবল বাউন্ডারি স্বাধীনতা দিয়ে মুড়েছি। বিগত ৫৪ বছরের মধ্যে মাত্র একবার রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমানের সময় দেখেছি। দ্বিতীয়বার দেখেছি বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে, সামান্য একটু। তার পূর্বমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পররাষ্ট্রনীতির চেতনায় একটি মাইলফলক গেড়েছিল মাত্র। তা নতুন বিন্যাসে সাজানোর সময় তিনি পাননি। তার চিন্তা-চেতনাই আমাদের উদ্দীপিত করেছিল। পরবর্তী সরকারের নতজানু নীতি আমাদের অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১.২
১৯৭১ সালে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে শামিল হই, তখন ভারত ও রাশিয়া বিপুলভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে জায়গা দিয়ে ভারত আমাদের মাথার টোপর হয়ে যায়। আর রাশিয়ান অস্ত্র আমাদের স্ট্রাইকিং সামরিক শক্তি হিসাবে সাহস জোগায় মুক্তিযুদ্ধের দিন-রাতগুলোতে। কৃতজ্ঞচিত্তে আমরা তা স্মরণ করি এবং তাদের অবদানকে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে স্বীকার করি। কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকার সেই অবদানের স্বীকৃতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। ফলে গত পনেরো বছরে দেশের জনগণ বোঝে যে, তারা একটি নব্য ভারতপন্থি ফ্যাসিস্টের অধীনে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী করদের ভূমিকায় পরিণত হয়েছিল। সেই করদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছে তরুণ শিক্ষিত ছাত্রসমাজ এবং দ্রোহী চেতনার নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত মানবসমাজ। তারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন দিয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলেও ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন, গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, চূড়ান্ত গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। সেই উত্তাল গণসুনামির তোড়ে হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে এবং সেখানে আশ্রয় পান। এর ভেতর দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে, তিনি ছিলেন দিল্লির শাসনাধীন এক করদ শাসক।
১.৩
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মনে ও মননে নেই নতুন চিন্তার স্ফুরণ। তাই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ ও রাজনৈতিক কেওয়াস আমরা লক্ষ করছি। সেই ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ সরকার যোগ করে গুম-খুনের ভীতি আর লুটেপুটে দেশকে রিক্ত করার এক আত্মধ্বংসী প্রবণতা, যা অতীতের শাসকদের মধ্যে ছিল না। তাদের মধ্যে ভুলভ্রান্তি ছিল, চিন্তাভাবনায় সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু মানুষকে হত্যা করে, গুম-খুন করে ভীতির সাম্রাজ্য কায়েমের প্রবণতা ছিল না। দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ আর প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যানের বাইরে তারা ছিলেন অনড় প্রতিভাবান। একমাত্র ব্যতিক্রম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দেড় বছর আগে, কিংবা তারও আগে ৩১ দফা ঘোষণা করেন। সেই ৩১ দফা রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারসহ এমন কিছু বিষয়ে, যা প্রকৃত অর্থেই জনগণের মৌলিক আশার প্রতিফলন। এ দলের ভেতরে কিছু চিন্তাশীল মানুষ আছেন, যারা পরিবর্তন ও সংস্কার চান, কিন্তু তাতে রয়েছে তাদেরই গোষ্ঠীস্বার্থ ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণা। এই বাধা থেকে বিএনপিকে বেরিয়ে আসতে হবে।
২.০
এবার আসা যাক কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক কৌশলের বিষয়ে। এর প্রধান বিষয় হচ্ছে দেশের মানুষের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সম্পদ রক্ষা ও তার নিরাপত্তা বা নিরাপদ রাখার উদ্যোগ আয়োজন। সম্প্রতি ঢাকায় একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্র্যক্রম পরিচালনার এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপডমেন্ট স্টাডিজ (এফএসডিএস) নামের এ প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সাবেক সেনাপ্রধান নূরউদ্দিন খান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামরুল আহসান, বিমানবাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনী প্রধান নাজমুল হাসান প্রমুখ। সেনাপ্রধান তার বক্তৃতায় বলেছেন, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কোন কোন ক্ষেত্রে জোর দেওয়া উচিত, তা গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে। একইসঙ্গে খাদ্য, পানি, জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রেই গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। এফএসডিএস প্রতিষ্ঠাকে সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসাবে বর্ণনা করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, সুশাসন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সংহতির জন্য গবেষণাভিত্তিক নীতিকাঠামো দরকার। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন এ প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন সেনাপ্রধান।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
- ভূরাজনীতি