
এ দেশ কার জন্য অভয়ারণ্য হবে
সম্প্রতি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারে আক্রমণ চালিয়ে কিছু ব্যক্তি সব বইপুস্তক নিয়ে যায়। তাদের ইচ্ছে ছিল আগুন দিয়ে লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসারের হস্তক্ষেপে লাইব্রেরিটি ভস্মীভূত হওয়া থেকে মুক্তি পায়। অতঃপর বইপুস্তকগুলো উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে সমাজের চাপে সেগুলো আবার ফেরত দেয়। কিন্তু যারা এই কাজটি করেছিল, তারা বলেছে রবীন্দ্রনাথ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং প্রথম আলো নাস্তিক তৈরির কারখানা; তাঁদের বিরুদ্ধে গুরুতর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই প্রতিরোধ কীভাবে গড়ে উঠবে, কারা প্রতিরোধ করবে, তা আমাদের সবারই জানা। কয়েক মাস ধরে এই পরিস্থিতি চলছে এবং মবের মাধ্যমে বিষয়গুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে।
আমরা জানি, সভ্যতার ক্রমবিকাশে লাইব্রেরির একটি ভূমিকা আছে। লাইব্রেরির ধারণা না এলে পৃথিবীর কালজয়ী সব দর্শনশাস্ত্র গ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ, পবিত্র কোরআন—কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকত না। যদিও সব সময়ই যুদ্ধবাজ আক্রমণকারীরা যেকোনো শহর ধ্বংস করার আগেই লাইব্রেরি ধ্বংস করাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে মনে করে। সাম্প্রতিককালে ইরাকের বাগদাদের লাইব্রেরিটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ধ্বংস করেছে এবং সেখানে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সব দলিল, হাতে লেখা কোরআন শরিফ—এসব মহামূল্যবান জ্ঞানভান্ডার ছিল, সেগুলো ভস্মীভূত হয়ে গেছে। জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে অমানবিকতার শক্তি সব সময়ই সক্রিয় ছিল। এবারেও সেই ঘটনার ব্যত্যয় ঘটেনি। অনেক লাইব্রেরি এবং মূল্যবান দলিল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, শিল্প-সাহিত্যের ওপরও আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। কোথাও মিলনায়তন কর্তৃপক্ষকে তৌহিদি জনতার নামে চিঠি দিয়ে নাট্যানুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। মবের প্রতি মানুষের একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বহু কায়ক্লেশে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলেছে। কিছু জ্ঞানচর্চার কর্মী এই লাইব্রেরিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করে শিশু, কিশোর, তরুণ ও বয়স্ক মানুষের একটি জ্ঞানভান্ডার তৈরির চেষ্টা করছে। বহু বছর ধরেই এই চেষ্টাকে নানাভাবে প্রতিহত করার জন্য এলাকার প্রভাবশালী মানুষেরা অপচেষ্টা করে চলেছে। এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে গত সরকারও তেমনভাবে কোনো বাধা প্রদান করেনি। রাজনৈতিক শক্তি এটা বুঝতে শিখেছে যে জ্ঞানের চোখটা খুলে গেলে আদর্শহীন রাজনীতির জন্য একটা সমস্যা হবে। মানুষের কাছে সমাজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য গেলে মানুষ আলোচনামুখর হয়ে পড়বে এবং কালক্রমে এইসব জ্ঞানচর্চা তাদের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই ধনবাড়ীর জমিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় অবদান রেখেছিলেন। আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হল বা বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সক্রিয় সমর্থন পাওয়া যায়। রাজনীতি, জ্ঞানচর্চা, বয়নশিল্পের প্রসারের বিষয়ে টাঙ্গাইলের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। অনেক রাজনীতিক, কবি, বুদ্ধিজীবী অধ্যুষিত এই জেলা একদা জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এখন জ্ঞানচর্চার অভাবে স্কুল, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও একধরনের নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা পালন করেন। টাঙ্গাইল এখন শিক্ষার ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টার, ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতির ক্ষেত্র এবং দুষ্ট রাজনীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
এককভাবে এটি যে টাঙ্গাইলেই ঘটছে তা নয়, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিষয়টি এখন ধ্বংসাত্মক পথে চলে গেছে। কিন্তু তার আগে ছিল জ্ঞানচর্চার শূন্যতা। আসলে এই শূন্যতার সূচনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। স্কুল-কলেজে নকলের দৌরাত্ম্য, কালে কালে পেশিশক্তির আবির্ভাব এবং সরাসরি ক্ষমতাসীন দলগুলোর স্কুল-কলেজে ম্যানেজিং কমিটি দখলের পাঁয়তারা হয়ে আসছে। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট, ইউটিউব, টিকটক এই মাধ্যমগুলো মানুষকে পাঠবিমুখ করে তুলছে। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় গণমাধ্যমের প্রবল উন্নতির মুখেও মানুষের পাঠপ্রবণতা কমেনি বরং বেড়েছে। কারণ, অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের চেয়ে ওই পাঠের মাধ্যমে যে জ্ঞান, সেটি নানা কারণে অনেক বেশি ফলপ্রসূ এবং স্থায়ী হয়।
অনেক দেশেই সারা বছর ধরে নতুন নতুন প্রকাশনা হয় এবং একুশের বইমেলার মতোই বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলো চলতে থাকে। সেই মেলাগুলোতে যে পরিমাণ বই বিক্রি হয় তাতে প্রতিবছরই আগের বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বইমেলাও রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে আমাদের দেশে। ক্ষমতাসীন সরকারের অপছন্দের কোনো প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত হয়ে থাকে, প্রকাশকের ওপর খড়্গ নেমে আসে, এমনকি বইমেলার স্টলেও আক্রমণ চলে। এই প্রবণতা খুব দ্রুত সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে, তাতে পেশিশক্তির জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- হামলা
- অগ্নিসংযোগ
- পাঠাগার