আজকে পত্রিকা পড়তে গিয়ে দুটি খবরে চোখ আটকে গেছে। প্রথম খবরটি আসন্ন বাজেটে শহীদ পরিবার ও আহতদের সহযোগিতায় সরকারের বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় বরাদ্দ আগামী অর্থবছরে আড়াই গুণ বেড়ে ৫৯৩ কোটি টাকা হচ্ছে। অর্থবছরের শুরু থেকেই শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের মাসিক ভাতা দেওয়ার পাশাপাশি এককালীন অর্থ এবং চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হবে।’ (শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য বরাদ্দ বাড়ছে, সমকাল, ২৭ এপ্রিল ২০২৫)
শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য সরকার বরাদ্দ বৃদ্ধি করবে—এটাকে ইতিবাচক পদক্ষেপই বলতে হবে। যাঁরা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখযোদ্ধা, স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে যাঁরা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে তাঁদের জন্য কিছু করার। রাষ্ট্রের তরফ থেকে আর্থিক সহযোগিতা, সম্মানী বা ভাতা দেওয়া সে রকমই একটা কিছু। এ কারণে খবরটা পড়ে একধরনের ইতিবাচক বা ভালো লাগার অনুভূতিই তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু ভালো লাগার ওই অনুভূতি খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরেকটি খবরের দিকে চোখ যায়। সেটি হলো ধর্ষণের শিকার এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর। এই খবরের শিরোনাম হলো, ‘ধর্ষণের শিকার জুলাই আন্দোলনে শহীদের মেয়ের আত্মহত্যা’। (সমকাল, ২৭ এপ্রিল ২০২৫)
আন্দোলন চলাকালে মেয়েটির বাবা গত বছরের ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ১০ দিন পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। গত ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় বাবার কবর জিয়ারত করে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নে নানাবাড়িতে ফেরার পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন কলেজশিক্ষার্থী মেয়েটি।
ধর্ষণের সময় মেয়েটির নগ্ন ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিল ধর্ষণকারীরা। এরপরও সব হুমকি, ভয়ভীতি ও ‘লোকলজ্জা’ উপেক্ষা করে মেয়েটির পরিবার ২০ মার্চ থানায় গিয়ে অভিযোগ করে। এরপর পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তারও করেছিল।
মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিরা জামিন পেয়েছে। এ নিয়ে কিছুদিন ধরে হতাশ ছিলেন মেয়েটি। ধারণা করা হচ্ছে, আসামিরা জামিনে ছাড়া পাওয়ায় মর্মাহত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। (সমকাল, ২৭ এপ্রিল ২০২৫)
বাংলাদেশে ধর্ষণ ‘বিরল’ কোনো ঘটনা নয়, আত্মহত্যাও নতুন কিছু নয়, এমনকি ধর্ষণের শিকার মেয়ে বা নারীর আত্মহত্যার খবরও ‘অভূতপূর্ব’ নয়। তাহলে এ ঘটনা নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার বা মুষড়ে পড়ার কী আছে?
বিচলিত হতে হচ্ছে, কারণ আত্মহত্যা করা মেয়েটি একজন শহীদের মেয়ে। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে মেয়েটি প্রথমে তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর মার্চ মাসে তিনি নিজে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ‘অপমান’ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন। একজন শহীদের কন্যা হিসেবে মেয়েটির যখন সম্মান পাওয়ার কথা, তখন তাঁকে কেন ধর্ষণের শিকার হয়ে ‘অপমানিত’ হতে হলো? এটা কি শহীদ পরিবারটির প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলার ফলাফল?
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেছেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শহীদ পরিবারের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম দায়িত্ব ছিল। কিন্তু এই নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। (শহীদ পরিবারের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে: স্নিগ্ধ, জাগোনিউজ২৪ডটকম, ২৭ এপ্রিল ২০২৫)
একজন শহীদের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়া এবং তার আত্মহত্যার ঘটনাটি শুধু রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা নয়; এটা একই সঙ্গে আমাদের রাজনীতিরও ব্যর্থতা। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হলো ‘জুলাই স্পিরিট’ বা জুলাইয়ের চেতনা। যে দল বা রাজনৈতিক শক্তি এই জুলাইয়ের চেতনার কথা বেশি বেশি বলেছে, আমরা ধারণা করেছি তারা গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের পাশে থাকবে; তাঁদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করবে। বাস্তবে তেমনটা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বা ভাতা একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু তাঁদের সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে তাঁদের সেই সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারিনি, শহীদের মেয়ের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে সেটি প্রমাণ হয়ে গেল।